সৃষ্টির সূচনা থেকে তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে বন্ধন তৈরি করেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী আবদ্ধ হয় বিবাহবন্ধনে এবং তৈরি হয় সুখময় সংসার, তারপর সন্তান-সন্ততি। এভাবেই এগিয়ে চলেছে পৃথিবী।
যে মহান দয়াময় অদৃশ্য থেকে এসব সৃষ্টি করে চলেছেন, তিনি আমাদের এ নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘এই যে তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন- যাদের কাছে তোমরা প্রশান্তির আশ্রয় নাও। তিনিই তো তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা এবং মায়া গেঁথে দিয়েছেন, এটা তো তাঁরই নিদর্শন।’’ (সূরা রূম-২১)
এ বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনায় মহান আল্লাহ পাক নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নারীর জন্য মোহরানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যা আদায় করা পুরুষের জন্য আবশ্যক। ইসলামের পরিভাষায় দেনমোহর বা মোহরানা একান্তই কনের অধিকার ও প্রাপ্য, যা আদায় করা বরের জন্য ফরজ। প্রতিটি বিবাহিত পুরুষের ওপর অবশ্য আদায়যোগ্য আমল। হোক তা নগদ কিংবা বাকি। আজ কিংবা কাল।
মোহর মূলত একটি সম্মানী যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে। এটা নারীর মূল্য নয় যে তা পরিশোধ করার পর মনে করতে হবে, এ নারী এখন স্বামীর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। আবার তেমনিভাবে তা শুধু কথার কথাও নয়, যে শুধু মুখে মুখে নির্ধারণ করা হলো কিন্তু জীবনভর তা দেওয়ার কোনো তাগিদ থাকলো না। বরং স্ত্রীকে নিজের ঘরে আনার সময় উপহার হিসেবে তাকে এ মোহর দিতে হবে এবং সম্মান জানিয়ে তাকে নিজের ঘরে তুলতে হবে।
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েক জায়গায় স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘‘আর তোমরা নারীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও স্বেচ্ছায়, তবে তারা যদি তা থেকে কোনো অংশ মাফ করে দেয়, তখন তা তোমরা ভোগ করতে পার।’’
অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘‘নারীদের তাদের পরিবারের অনুমতি নিয়েই তোমরা বিবাহ করো এবং তাদের অধিকারটুকু ভালোভাবে আদায় করে দাও।’’ (সূরা নিসা-২৫)
একই প্রসঙ্গ আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন সূরা মুমতাহিনার ১০ নং আয়াতে এবং আরও কয়েক জায়গায়। বারবার তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নারীর অধিকার ও সম্মান যেন আদায় করা হয়।
বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে মোহর আদায় করা উচিত। তবে কারণবশত তখন অপারগ হলে কবে আদায় করবে- তা নির্ধারণ করতে হবে। রাসূল (সা.) এর যুগ এবং সাহাবিদের সময়েও কেউ নারীর মোহরানা বাকি রেখে বিয়ে করতেন না। রাসূল (সা.) নিজ হাতে যেসব বিয়ে দিয়েছেন, হাদীসের কিতাবসমূহে সেসবের বিবরণে দেখা যায়, তিনি নগদ মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করিয়েছেন- হোক তা লোহার আংটি কিংবা যুদ্ধে ব্যবহৃত বর্ম। বাকিতে মোহরানা দেওয়ার প্রচলত তখন ছিল না।
যেসব বিবাহিত পুরুষ আজও নিজেদের জীবনসঙ্গিনীর দেনমোহর আদায় করতে পারেননি কিংবা আদৌ তা পরিশোধের ইচ্ছা নেই, তাদের ব্যাপারে বায়হাকী শরীফের বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেছেন, যে পুরুষ বিয়ে করলো এবং মৃত্যু পর্যন্ত সে স্ত্রীর মোহরানা আদায়ের ইচ্ছাও করেনি, তবে সে অবৈধ ব্যভিচারকারী (ধর্ষণকারী) হিসেবে গণ্য হবে।
ইমাম আহমদের বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, মোহর আদায় করার নিয়ত ছাড়া যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে আর আল্লাহ পাক তো ভালো করেই জানেন যে তার মনে মোহরের নিয়ত নেই, তবে এই লোক যেন আল্লাহকে ধোঁকা দেওয়ার স্পর্ধা দেখালো এবং অন্যায়ভাবে তার স্ত্রীকে ভোগ করলো। কিয়ামতের দিন সে ব্যভিচারকারী পুরুষ হিসেবে উপস্থিত হবে।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, পাত্রীদের পক্ষ থেকে যদি পাত্রের সাধ্য অনুযায়ী মোহরানা ধরা হয়, তবে তা সবচেয়ে উত্তম। একথাও সত্য যে, মোহরানার ব্যাপারে ইসলাম সর্বনিম্ন কিংবা সর্বোচ্চ অংক বেঁধে দেয়নি। বরং তা সমাজ এবং সাধ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে রাসূল (সা.) এও বলেছেন, সাধারণ আয়োজনের বিয়েই সর্বোত্তম বরকতময়।
তার মানে এই নয় যে এতো সামান্য পরিমাণ মোহর ধরা হলো, যা স্ত্রীর সম্মান উপযোগী নয় কিংবা এতো চড়াও নয় যা স্বামীর সাধ্যের বাইরে।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হচ্ছে দশ দিরহাম বা ৩০ গ্রাম রূপার সমমূল্য।
রাসূল (সা.) নিজের মেয়ে এবং স্ত্রীদের বেলায়ও যে মোহরানা ধরেছিলেন তার পরিমাণ পাঁচশ’ দিরহাম বা ১৩১ তোলা ৩ মাশা রূপার সমমূল্য। (ইবনে মাজাহ-১৫৩২)
এবং রাসূল (সা.) নিজের স্ত্রীদের বেলায়ও এ পরিমাণ মোহরানা আদায় করেছেন। তবে উম্মে হাবিবা (রা.) এর বেলায় এর পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম। (আরও বিস্তারিত জানতে মুসলিম শরীফ-১৪২৬, আবু দাউদ-২১০৫, নাসায়ী-৬/১১৬-১১১৯)
মনে রাখা প্রয়োজন, ‘মোহরে ফাতেমি’ ধরতেই হবে, এমন কোনো নিয়ম ইসলামী শরিয়তে নেই। তবে কেউ যদি রাসূলের (সা.) এ পরিমাণকে বরকতময় মনে করে তা হিসাব করেন, তাতেও অসুবিধা নেই।