মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আমাদের মুসলমানদের বর্তমানকার ক্রমবর্ধমান বিভক্তি সম্পর্কে ভালভাবে বুঝতে হলে সুদূর অতীতে বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তিগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই ধরনের অনেক (ফিতনাবাজ) ছিল, যাদের কেউ কেউ অত্যন্ত গোঁড়াপন্থী। কিন্তু এদের মধ্যে শুধু দু’টি গণমুখি আন্দোলনের রূপ নেয়, যার চালিকা-শক্তি ছিল ধর্মীয় মতবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মবিশ্বাস ও মনীষার বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহ। সঙ্গত কারণেই এই দুটো আন্দোলন খারেজীবাদ ও শিয়াবাদের নাম অর্জন করে। সুন্নী মতাদর্শের সাথে বৈসাদৃশ্য রেখে এই দু’টি মতবাদ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ও উপ-আন্দোলনের জন্ম দিতে পেরেছে। তথাপি ইসলামে ধর্মীয় কর্তৃত্বের উৎসসম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নে মুসলমানদের মূলধারা হতে পৃথক দু’টি মতবাদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় এরা মতপার্থক্যের চিহ্নিত দু’টি ধারা হিসেবে টিকে গিয়েছে।
হযরত আলী (ক:)-এর বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তি)-পরবর্তীকালের অন্ধ সমর্থক (শিয়া)-রা পূর্ববর্তী খলীফাবৃন্দকে নৈতিকভাবে অধঃপতিত মনে করে ধর্মীয় কর্তৃত্বের এমন একটি থিওরীর জন্ম দেয়, যা ঐতিহ্যবাহী সাম্যের ধারণাকে পরিত্যাগ করে ধর্মীয় কর্তৃত্ব অর্পণ করে ভক্তি সঞ্চারের ক্ষমতাধর ইমামবর্গের এক পরম্পরার কাছে। আমাদের এখানে থামা উচিত হবে না এই প্রশ্নের উত্তর যাচাই করতে যে প্রাচ্যদেশীয় খৃষ্টমত হতে ধর্মান্তরিত কতিপয় নও-মুসলিম দ্বারা এ ধারণাটি প্রভাবিত ছিল কি-না, যারা যীশু খৃষ্টের ভাববাদী বার্তাবাহক (হাওয়ারী)-দের উত্তরাধিকারের ধারণায় পুষ্ট ছিল, যে দানের বদৌলতে অনুমান করা হয় খৃষ্টান চার্চকে দেয়া হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মাঝে যীশু খৃষ্টের দর্শন প্রচারের অনন্য ক্ষমতা। এখানে সঠিকভাবে যার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন তা হলো, প্রাথমিক যুগের ইসলামী সমাজে ব্যাপকভাবে অনুভূত চূড়ান্ত ধর্মীয় কর্তৃত্বের অভাবের প্রত্যুত্তর হিসেবেই অগণিত সংখ্যক আকার-আকৃতির শিয়া মতবাদ বিকশিত হয়েছিল। খুলাফায়ে রাশেদীন তথা সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ শাসকদের যুগ শেষ হয়ে এলে পরে, এবং মো’মেন (বিশ্বাসী)-দের নেতা হিসেবে যে জীবন যাপন পদ্ধতি উমাইয়া শাসকবর্গের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, তা হতে তাঁরা নজর-কাড়া ক্রমাগত বিচ্যুতিতে গা ভাসালে, চরম পরস্পরবিরোধী ও সদ্য জন্ম নেয়া ফেকাহর মযহাবগুলোকে এমতাবস্থায় মনে হচ্ছিল ধর্মীয় বিষয়াদিতে শক্তিশালী ও দ্ব্যর্থহীন কর্তৃত্ব রক্ষায় ঘাটতিপূর্ণ। এরই ফলশ্রুতিতে নিখুঁত ইমামসম্পর্কিত ধারণার অপ্রতিরোধ্য চিত্তাকর্ষণ বারংবার ঘটতে থাকে।
ইমাম মতবাদের উত্থানের এই ব্যাখ্যাটি শিয়া মতবাদের সম্প্রসারণের দ্বিতীয় বড় পর্যায় সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতেও সহায়তা করে। হিজরী পঞ্চম শতকের সুন্নী পুনর্জাগরণের সাফল্যের পরে যখন সুন্নী মতাদর্শকে অবশেষে অবিভক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনি শিয়া মতবাদ ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। এর চরমপন্থী শাখা, ইসমাইলী শিয়া সম্প্রদায়, ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর তোপের মুখে পড়ে, যাঁর প্রণীত ‘বাতেনীদের নানা কলংক’ বইটি তাদের গোপন ধ্যান-ধারণাকে প্রলয়ংকরী শক্তিসহ উম্মোচিত ও মূলোৎপাটিত করে। শিয়াদের এই পতন সপ্তম হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে থামে, যখন চেঙ্গিস খানের অধীনে মংগল বাহিনী ইসলামের শাসনাধীন মধ্য (এশীয়) অঞ্চলের দেশগুলো দখল করে নেয় এবং ধ্বংস করে ফেলে। এই আক্রমণের ভয়াবহতা কল্পনাতীত; উদাহরণস্বরূপ, আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, হেরাট শহরের এক লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মাত্র চল্লিশজন আগুনে ভস্মিভূত নগরীর ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরিয়ে আসেন ওই ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হতে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির এই করাল গ্রাস কাটতে না কাটতেই নব্য-ধর্মান্তরিত তুর্কমান যাযাবর জাতি বিধ্বস্ত নগরীগুলোতে প্রবেশ করে; নগরীগুলোর সুন্নী উলেমাবৃন্দ ইতোমধ্যে শহীদ হওয়ায় এবং ভয়-ভীতি ও গণ্ডগোলের পরিবেশ বিরাজ করায়, অধিকন্তু আকাশে-বাতাসে মুক্তিদূত আবির্ভাবের প্রত্যাশা থাকায় তুর্কমান যাযাবর জাতি শিয়া মতবাদের সবচেয়ে উগ্র আকার ধারণ করে। শিয়াদের ইরান দখল, যা এক সময় সুন্নীদের অনুগত রাজ্য ছিল, তা ইতিহাসের ওই বেদনাদায়ক অধ্যায়েই সংঘটিত হয়েছিল।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে অপর যে ভিন্ন মতাবলম্বী দলের আবির্ভাব ঘটে, তা হলো খারেজী সম্প্রদায় – যারা আক্ষরিক অর্থেই ’খারিজ’ বা ধর্মত্যাগী; তারা এই খেতাবে ভূষিত, কারণ তারা খলীফা হযরত আলী (ক:)-এর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করেছিল যখনই তিনি আমীরে মোয়াবিয়া (রা:)-এর সাথে তাঁর বিরোধ সালিশে নিষ্পত্তি করতে সম্মত হন। “ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি” (আল্লাহর আদেশ ছাড়া কোনো হুকুম নেই) – কুরআন মজীদের এই আয়াতটি প্রদর্শন করে তারা হযরত আলী (ক:) ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে; তাঁর সৈন্যবাহিনীতে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর নেতৃস্থানীয় সাহাবী (রা:)-বৃন্দও ছিলেন। অবশেষে হযরত আলী (ক:) নাহরাওয়ান-এর যুদ্ধে খারেজীদেরকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধে দশ হাজারের মতো খারেজী মারা যায়।
প্রথম দিককার খারেজীরা মারা গেলেও খারেজী মতবাদ নিজে টিকে থাকে। এই মতবাদ নিজেকে সূত্রবদ্ধ করার সময় শিয়া মতবাদের ঠিক উল্টো রূপ পরিগ্রহ করে, ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে বা ভক্তি-শ্রদ্ধার বদৌলতে প্রাপ্ত নেতৃত্বের যে কোনো ধারণাকে এটি প্রত্যাখ্যান করে এবং একমাত্র পুণ্য কর্মের ভিত্তিতেই ঈমানদারদের সমাজের নেতৃত্ব বাছাইয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। অত্যন্ত মৌলিক মাপকাঠি দ্বারা এটি নিরূপণ করা হয়: প্রথম দিককার খারেজীরা আমল পালনে তাদের কঠোর নীতির কারণে পরিচিত ছিল; আর এই কঠোর মতবাদের দৃষ্টিতে যে মুসলমান-ব্যক্তি বড় পাপ (গুনাহে কবীরাহ) সংঘটন করেন, তিনি অবিশ্বাসী (কাফের) হয়ে যান। ‘তাকফির’ তথা অবিশ্বাসের এই ধারণাটি খুজেস্তানের প্রত্যন্ত পার্বত্য জেলাগুলোতে তাঁবু ফেলে থাকা খারেজী দলগুলোকে উমাইয়া শাসনের প্রতি আনুগত্য স্বীকারকারী মুসলমানদের বসতি আক্রমণের অনুমতি এনে দেয়। এই সব অভিযানে অ-খারেজীদেরকে নিয়মিতভাবে হত্যা করা হতো, যার দরুণ আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফের মতো প্রতাপশালী উমাইয়া শাসকবর্গ নির্মম দমনমূলক পাল্টা ব্যবস্থা নিতেন। তবে খারেজীদের উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ড হতাশাব্যঞ্জক হওয়া সত্ত্বেও আক্রমণগুলো চলতে থাকে। খলীফা হযরত আলী (ক:) শহীদ হন নাহরাওয়ানের যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসা ইবনে মুলজাম নামের এক খারেজীর হাতে; অপর দিকে, মুহাদ্দীস ইমাম নাসাঈ (রহ:), ‘সুনান’ শীর্ষক হাদীসগ্রন্থের যিনি প্রণেতা, তাঁকে ৩০৩ হিজরী/৯১৫ খৃষ্টাব্দ সালে দামেশকে খারেজী উগ্রবাদীরা একইভাবে শহীদ করে। শিয়া মতবাদের মতো খারেজীবাদও ইরাক ও মধ্য এশিয়ায় এবং সময়ে সময়ে অন্য এলাকায়ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে, ঠিক ইসলামের চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এই সময়ে এসেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। সুন্নী মতাদর্শ একটি বিস্তারিত ব্যবস্থা হিসেবে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় আবির্ভূত হয়, যা এই সময় সমাধানমূলক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ উলেমাবৃন্দের পথ ও মতের এমন উজ্জ্বল প্রতিফলনকারী ছিল যে প্রতিদ্বন্দ্বী আন্দোলনগুলোর আকর্ষণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।