মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
ঘটনা এই যে, সমতাবাদী খারেজী মতবাদ ও শিয়া আধিপত্যপরম্পরার চরম দুই পন্থার মাঝামাঝি অবস্থানকারী সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক ইসলাম দীর্ঘ সময় যাবত নিজের কর্তৃত্বের ধারণা সম্পর্কেই মতপার্থক্যে জড়িয়ে ছিল। সুন্নীদের কাছে কর্তৃত্ব মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহতে নিহিত। কিন্তু এতো বিশাল এক হাদীসশাস্ত্র যা সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও তাঁদের অনুসারীদের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার দরুণ সমগ্র ইসলামী বিশ্বের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন আকৃতিতে ও বর্ণনায় বিস্তার লাভ করেছিল, তার মুখোমুখি হয়ে সুন্নাহকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা কখনো কখনো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এমন কি এই বিশাল সম্ভার, যার সমষ্টি কয়েক লক্ষ রওয়ায়াত (বর্ণনা), তা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসগুলো বাছাই করে নেয়ার পরও এমন কিছু হাদীস ছিল যেগুলো দৃশ্যতঃ পরস্পরবিরোধী, বা আল-কুরআনের আয়াতের সাথেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি স্পষ্ট ছিল যে খারেজীদের মতো হাদীসের একটি ছোট্ট সংগ্রহশালা গঠন করে তা থেকে সরাসরি নীতিমালা প্রণয়ন ও আইন-কানুন বের করার সহজ পন্থা অবলম্বন এ ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়। হাদীসগুলোর অভ্যন্তরীন অসামঞ্জস্য এতো অধিক সংখ্যক এবং সেগুলোর প্রতি আরোপিত ব্যাখ্যাগুলো এতো জটিল ছিল যে কাজী (বিচারক)-মণ্ডলীর পক্ষে স্রেফ কুরআন মজীদের ও হাদীস শাস্ত্রের কোনো সংশ্লিষ্ট পাতা খুলে রায় দেয়া সম্ভবই ছিল না।
প্রাথমিক যুগের উলেমাবৃন্দ বিভিন্ন লিপির মধ্যকার বাহ্যিক অসঙ্গতির অন্তর্নিহিত কারণগুলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করেন; এটি করার সময় অহরহ-ই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন প্রথিতযশা উলেমাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক চলেছিল। উসূলে ফেকাহ (ইসলামী বিধানের মৌলনীতি)-এর বেশির ভাগ অংশ প্রণয়ন করা হয়েছিল এ ধরনের অসঙ্গতি দূরীকরণের একটি নিয়ম, যা ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করে, তা জারি করতে। ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লা’ (প্রামাণ্য দলিলাদির পরস্পরবিরোধিতা) শব্দটি মুসলমানদের আইনশাস্ত্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও জটিল বিষয় হিসেবে ইসলামী ফেকাহর সকল ছাত্রের কাছেই পরিচিত। ইবনে কুতাইবা (রহ:)-এর মতো প্রাথমিক যুগের আলেমবৃন্দ এই বিষয়ে গোটা বই উৎসর্গ করার বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছিলেন। উসূলের উলেমাবৃন্দ তাঁদের গবেষণার শুরুতেই ধরে নেন যে শাস্ত্রলিপির পরস্পরবিরোধিতা মহানবী (দ:) কর্তৃক প্রকাশিত বিধাতা (খোদাতা’লা)-র ঐশী বিধানের অসঙ্গতি প্রতিফলন করে না, বরং তা বিভিন্ন ব্যাখ্যার অসামঞ্জস্যতা-ই পরিস্ফুট করে। ইসলামের মর্মবাণী হুযূর পূর নূর (দ:)-এর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলন)-প্রাপ্তির আগেই নিখুঁতভাবে পৌঁছানো হয়েছিল; আর এর অব্যবহিত পরের উলেমাবৃন্দের কাজ ছিল শুধু তা ব্যাখ্যা করা, সংস্কার বা সংশোধন করা নয়।
ইসলামের মৌলিক শাস্ত্র যে শুধু ব্যাখ্যা-ই করা যায়, সে বিষয়ে সচেতন হয়ে ইসলামী জ্ঞান বিশারদবৃন্দ জটিল দলিল-আদিল্লা পরখ কালে কিছু প্রাথমিক তত্ত্বগত পরীক্ষা ও সমাধান-পদ্ধতির সিরিজ প্রয়োগ করতেন। পূর্ববর্তী যুগের উলামাবৃন্দ যে পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন তা হলো, দুটো কুরআন মজীদের আয়াত বা দুটো হাদীস শরীফ যদি পরস্পরবিরোধী প্রতীয়মান হতো, তবে উলেমাবৃন্দ সেগুলোর এবারত/লিপির ভাষা বিশ্লেষণ করতেন, যাতে আরবী থেকে ব্যাখ্যা করার সময় কোনো ভুলের কারণে এই পরস্পরবিরোধিতার উৎপত্তি হয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করা যায়। এই পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করা না গেলে উলেমাবৃন্দ শাস্ত্রলিপিগত, আইনী ও ইতিহাস রচনাগত এই তিনটি দিকের সমন্বিত কৌশলের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে চেষ্টা করতেন ওই দুটো দলিলের মধ্যে কোনোটি ’তাখসিস’-এর আওতাভুক্ত কিনা; অর্থাৎ, সেটি কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হওয়ায় অপর দলিলটিতে বিবৃত অধিকতর সার্বিক নীতির সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম কিনা। ফকীহবৃন্দকে বিভিন্ন রওয়ায়াত (বর্ণনা)-এর শাস্ত্রগত নির্ভরযোগ্যতাও নির্ণয় করতে হতো। তা এই নীতির ভিত্তিতে হতো যে একটি এসনাদ-বিশিষ্ট (আহাদ জাতীয়) বর্ণনাসম্বলিত হাদীসকে আল-কুরআনের যে কোনো আয়াত নাকচ করে দিতে সক্ষম, যেমনিভাবে তা নাকচ করতে সক্ষম অনেকগুলো এসনাদ-বিশিষ্ট কোনো হাদীস (মোতাওয়াতের/মাশহুর জাতীয়)। এই সকল পদ্ধতি প্রয়োগের পরও যদি ফকীহবৃন্দ তাতে সমস্যাটি বিদ্যমান দেখতে পেতেন, তাহলে দুটো দলিলের একটির দ্বারা অপরটি ’নাসখ’ (রহিত) হয়েছে কিনা তার সম্ভাব্যতা তাঁদেরকে যাচাই করে দেখতে হতো।
’নাসখ’-এর এই নীতি এমন একটি উদাহরণ যা দ্বারা প্রতিভাত হয় সুন্নী উলেমাবৃন্দ ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লাহ’-এর মতো সূক্ষ্ম ও নাজুক বিষয়গুলোতে কীভাবে শাস্ত্রগত নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে সমাধান খুঁজতেন; আর তাঁদের ওই পদ্ধতি অনেক আগেই বহুবার মহানবী (দ:) কর্তৃক তাঁর হায়াতে জিন্দেগীর সময় স্বীকৃত হয়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ‘এজমা’ তথা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জানতেন যে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালতের প্রথম বছরগুলোতে তিনি যখন তাঁদেরকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং তাঁদের যত্ন নিচ্ছিলেন, আর তাঁদেরকে অংশীবাদের বিভ্রান্তি থেকে আল্লাহর একত্ববাদের ঐকান্তিক ও করুণাময় পথে সরিয়ে নিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা ও বাণী তাঁদের (জাগতিক ও পারলৌকিক) উন্নতির সাথে যেন খাপ খায় ঠিক তেমনি ঐশীভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছিল। এটির সবচেয়ে ভালভাবে জ্ঞাত নজির হলো ধাপে ধাপে মদ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি, যা প্রথম দিককার একটি কুরআনের আয়াতে অনুৎসাহিত করা হয়; অতঃপর এর নিন্দা করা হয়, এবং সবশেষে নিষিদ্ধ করা হয়। ইসলামের আরও মৌলিক নীতির সাথে সম্পৃক্ত নামাযের বিধানটিও এর আরেকটি উদাহরণ। প্রাথমিক সময়কার উম্মতের প্রতি দৈনিক দুই ওয়াক্ত নামায পড়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মে’রাজ রাতে এই বিধান দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে উন্নীত করা হয়। মো’তাহ (সাময়িক) বিয়েকেও ইসলামের সূচনালগ্নে অনুমতি দেয়া হয়, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি, নারীর প্রতি সম্মান বৃদ্ধি ও নৈতিকতার শেকড় অন্তরের গভীরে গেঢ়ে বসার পর তাও পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ করা হয় [এ প্রথা ও মদ্যপানের রেওয়াজ পূর্ববর্তী আরবীয় ঐতিহ্য ছিল – অনুবাদক]। এ রকম আরও অনেক নজির রয়েছে যার অধিকাংশ ঘটনা হিজরতের পরে ঘটেছিল, যখন এই অল্পবয়সী উম্মতের পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে।