মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
’নাসখ’ (রহিতকারী শরয়ী দলিল) দুই প্রকার: ‘সারিহ’ (সুস্পষ্ট) ও ‘দিমনি’ (অন্তর্নিহিত)। পূর্বোক্তটি সহজে বোঝা বা চিহ্নিত করা যায়, কেননা তাতে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন শাস্ত্রলিপি যা সুনির্দিষ্টভাবে জ্ঞাত করেছে পূর্ববর্তী কোনো আইনের পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ, কুরআন মজীদে একটি আয়াতে করীমা (২:১৪২) আছে যেটি মুসলমানদেরকে জেরুসালেম থেকে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তনের আদেশ করে। হাদীসশাস্ত্রে এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরও ঘন ঘন দেখা যায়; যেমন – ইমাম মুসলিম (রহ:) বর্ণিত একটি হাদীস এরশাদ ফরমায়: “আমি ইতিপূর্বে তোমাদেরকে কবর যেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম; এখন থেকে যেয়ারত করো!” এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দীস উলেমাবৃন্দ বলেন যে ইসলামের সূচনালগ্নে মূর্তি পূজোর স্মৃতি মানুষের মনে তখনো তাজা থাকায় কিছু মুসলমান তাতে বিভ্রান্ত হতে পারেন এমন আশংকা থেকে কবর যেয়ারত নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর একত্ববাদ সংক্রান্ত মুসলমানদের বিশ্বাস সুদৃঢ় হওয়ার পরপরই এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আজ তাই কবরস্থদের জন্যে দোয়া করা এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করার জন্যে কবর যেয়ারত করা মুসলমানদের মাঝে একটি আদিষ্ট প্রথা। [উক্ত হাদীসের আদেশ যখন জারি হয়, তখন মুসলমানদের কবর ছিল না; সবই অমুসলিমদের সমাধি ছিল। মুসলমানবৃন্দ ইন্তেকাল করা আরম্ভ করলে তাঁদের মাযার-রওযা যেয়ারতের আদেশ জারি হয় – অনুবাদক]
’নাসখ’-এর দ্বিতীয় প্রকারটি আরও সূক্ষ্ম এবং এটি অহরহ-ই প্রাথমিক যুগের জ্ঞান বিশারদদের মেধার সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রয়াস বা খাটুনি আদায় করে নিয়েছিল। এতে সম্পৃক্ত ছিল সে সব শাস্ত্রলিপি যা পূর্ববর্তীগুলোকে নাকচ বা ব্যাপকভাবে সংস্কার করেছিল, কিন্তু তার কোনো উল্লেখ বাস্তবে তাতে ছিল না। উলেমাবৃন্দ এর বহু উদাহরণ পেশ করেছেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সূরা বাকারার দুটো আয়াত, যেখানে বিধবা নারীদের ‘ইদ্দত’-এর সময় কোনো সম্পত্তি থেকে কীভাবে ভরণ-পোষণ করা হবে সে সম্পর্কে পৃথক পৃথক আদেশ জারি হয়েছিল (২:২৪০ এবং ২:২৩৪)। আর হাদীসশাস্ত্রে এমন একটি দৃষ্টান্ত আছে যা’তে মহানবী (দ:) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (রা:)-কে বলেছিলেন তিনি অসুস্থতাহেতু বসে বসে নামায পড়লে তাঁরাও যেন তাঁর ইমামতিতে বসে নামায পড়েন। এই হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রহ:) কর্তৃক বর্ণিত। তথাপি আমরা ইমাম মুসলিম (রহ:)-এরই বর্ণিত আরেকটি হাদীসে দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ (দ:) বসে নামায আদায়ের সময় সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) তাঁর ইমামতিতে দাঁড়িয়ে নামায পড়েন। এই স্পষ্ট পরস্পরবিরোধিতা কালানুক্রমিক সযত্ন বিশ্লেষণের দ্বারা সমাধান করা হয়েছে, যা’তে প্রতীয়মান হয় যে শেষোক্ত ঘটনাটি পূর্বোক্ত ঘটনার পরেই ঘটেছিল। আর তাই তা পূর্বোক্ত ঘটনার চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে। মহান উলেমাদের ফেকাহ শাস্ত্রে এটি যথাবিহিত গুরুত্ব সহকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
’নাসখ’ (শরয়ী দলিল রহিতকারী অপর দলিল) চিহ্নিতকরণের কৌশলগুলো উলেমাবৃন্দকে অধিকাংশ স্বীকৃত ‘তায়ারুদ আল-আদিল্লা’ (শরয়ী দলিলসমূহের পরস্পরবিরোধিতা)-এর সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম করে তোলে। এ সব কৌশলের জন্যে প্রয়োজন ছিল কেবল হাদীসশাস্ত্র-সংক্রান্ত পূর্ণ ও বিস্তারিত জ্ঞান-ই নয়, বরং ইতিহাস, রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর সীরাহ মোবারক এবং সংশ্লিষ্ট হাদীসের উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে সাহাবা-এ-কেরাম (রা:) ও অন্যান্য উলামাদের মতামত-ও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটিমাত্র হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্যে মোহাদ্দীস উলামাবৃন্দ সারা ইসলামী দুনিয়া সফর করে বেড়াতেন।
সব ধরনের কৌশল বা পদ্ধতি প্রয়োগের পরও যদি রহিতকরণ প্রমাণ করা না যেতো, তবে সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক ৩ শতকের পুণ্যাত্মাবৃন্দ)-এর জ্ঞান বিশারদগণ আরও অতিরিক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করতেন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি ছিল ‘মতন’-এর বিশ্লেষণ (হাদীসের এসনাদের পরিবর্তে মূল বর্ণনা)। ‘সারিহ’ (স্পষ্ট) বক্তব্যকে ইশারা-ইঙ্গিতের (’কেনায়া’) চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হতো; আর ‘মোহকাম’ (সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট) কথাবার্তা অগ্রাধিকার পেতো দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যের চেয়ে; এই দ্ব্যর্থবোধক শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে ‘মোফাসসর’ (ব্যাখ্যাকৃত), ‘খফি’ (গোপন, অস্পষ্ট) এবং ‘মুশকিল’ (জটিল, সমস্যাসংকুল)। পরস্পরবিরোধী হাদীসগুলোর বর্ণনাকারীদের অবস্থাও বিবেচনা করা হতো, যার দরুণ যে বর্ণনাকারী যতো বেশি বর্ণনার সাথে সরাসরি জড়িত হতেন তিনি ততো-ই অগ্রাধিকার পেতেন। এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো হযরত মায়মুনাহ (রা:) বর্ণিত হাদীসটি, যা বিবৃত করে রাসূলুল্লাহ (দ:) যখন তাঁকে বিয়ে করেন তখন হুযূর পাক (দ:) হজ্জ্বের জন্যে এহরাম বাঁধা অবস্থায় ছিলেন না। যেহেতু তাঁর বিবরণটি ছিল চাক্ষুস সাক্ষ্যের, সেহেতু হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)-এর অনুরূপ নির্ভরযোগ্য এসনাদ-সমৃদ্ধ কিন্তু পরস্পরবিরোধী বর্ণনাটি, যা’তে ব্যক্ত হয়েছিল মহানবী (দ:) ওই সময় হজ্জ্বের ‘এহরাম’ বাঁধা অবস্থায় ছিলেন, তার চেয়ে হযরত মায়মুনা (রা:)-এর সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পায়।
এমন আরও অনেক নিয়ম আছে যেগুলো বিবৃত করে অনুমতির চেয়ে নিষেধাজ্ঞা অগ্রাধিকার পাবে। অনুরূপভাবে, পরস্পরবিরোধী হাদীসগুলোর মাঝে ফয়সালা পাওয়া যেতো কোনো সাহাবী (রা:)-এর ফতোওয়াকে সদ্ব্যবহার করে; তবে শর্ত ছিল এই যে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ফতোওয়ারও তুলনা ও মূল্যায়ন করতে হতো। সবশেষে, কেয়াস (তুলনামূলক বিচার-পদ্ধতির মাধ্যমে মুজতাহিদবৃন্দের রায়) প্রয়োগ করা হতো। এ রকম একটি উদাহরণ হলো ‘সালাত আল-কুসুফ’ (সূর্যগ্রহণের নামায)-এর বিভিন্ন বর্ণনা, যা রুকূ ও সেজদার ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার বিবরণ দিয়েছিল। উলেমাবৃন্দ এ সকল বর্ণনার সতর্ক বিচার-বিশ্লেষণশেষে ওপরে বর্ণিত কোনো পদ্ধতি দ্বারা এর সমাধান বের করতে না পেরে কেয়াস প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মর্মে, যেহেতু এটিকে ’সালাত’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেহেতু সালাত বা নামাযের নিয়মসিদ্ধ পদ্ধতি-ই অনুসরণ করতে হবে; অর্থাৎ, একবার রুকূ ও দু’বার সেজদা এতে থাকবে। এতদসংক্রান্ত অন্যান্য হাদীস এমতাবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে।