মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
ঐশী শাস্ত্রলিপি থেকে শরীয়তের নিখুঁত আইন-কানুন বের করার ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দলিলের ফয়সালাসূচক এই পদ্ধতির সতর্ক প্রয়োগ মূলতঃ ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এরই অনবদ্য কাজ ছিল। তাঁর সময়কার ফেকাহবিদদের মধ্যকার বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্য দেখতে পেয়ে এবং মনুষ্য ত্রুটি-বিচ্যুতির সম্ভাবনা যতোটুকু পারা যায় এড়িয়ে একটি সঙ্গতিপূর্ণ ফেকাহ-পদ্ধতি প্রবর্তনের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি তাঁর চমৎকার ‘রেসালা’ (ইসলামী ফেকাহ-বিষয়ক পুস্তক) রচনা করেন। অন্যান্য প্রধান প্রধান শরয়ী আইনবেত্তাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে তাঁর চিন্তা-ভাবনা সহসা গৃহীত হয়; যার দরুণ আজকে শরীয়তের আনুষ্ঠানিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগুলো মৌলিক বিষয় হয়ে গিয়েছে।
শরয়ী দলিল-আদিল্লার ভাণ্ডার থেকে ইসলামী আইন-কানুন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি কমানোয় ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর এই পদ্ধতি ‘উসূল আল-ফেকাহ’ (ফেকাহর মূলনীতি) নামে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে যায়। ইসলাম ধর্মের অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই এটি মন্দ অর্থে নতুন কোনো কিছুর প্রবর্তন (বেদআত) ছিল না, বরং মূলনীতি-ভিত্তিক এমন সমাধান ছিল যা ইতোমধ্যে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সময়ে দেখা গিয়েছিল। কালের পরিক্রমায় সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক প্রতিটি ফেকাহ-ব্যবস্থায় এই মূলনীতির আলোকে নিজস্ব নিয়ম-রীতি চালু করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শাখার উদ্ভব হয় (অর্থাৎ, আমল পালনের বেলায় একেক মযহাবের নির্দিষ্ট ফতোওয়া)। যদিও এ সব পার্থক্য হতে নিঃসৃত বিতর্ক কখনো কখনো উদ্যমী ছিল, তথাপি ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে উদ্ভূত বড় বড় অন্তঃকোন্দল ও আইনী মতপার্থক্য যা ‘উসূল আল-ফেকাহ’ শাস্ত্রের আবির্ভাব দ্বারা পরিসমাপ্ত হয়, তার তুলনায় ওই সমস্ত পার্থক্য তাৎপর্যহীন ছিল।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, যদিও চার মহান মুজতাহিদ ইমাম আবূ হানিফা (রহ:), ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ:), ইমাম শাফেয়ী (রহ:) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে চার মযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনে করা হয়, যে চার মযহাব সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞেস করা হলে আমরা সংক্ষেপে বলবো সেগুলো বেদআত তথা নতুন পরিবেশনা এড়ানোর সূক্ষ্ম কৌশল, তথাপি তাঁদের মযহাবগুলো পরবর্তী প্রজন্মের উলেমাদের দ্বারাই কেবল (বর্তমানের আকারে) প্রণালীবদ্ধ হয়। সুন্নী উলেমাবৃন্দ দ্রুত চার মযহাবের ইমামগণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেন এবং ইসলামের তৃতীয় শতকের শেষে আমরা দেখতে পাই যে এই চার মযহাব ছাড়া অন্য কোনো মযহাব অনুসরণ করার মতো কোনো আলেম-ই অবশিষ্ট ছিলেন না। ইমাম বুখারী (রহ:) ও ইমাম মুসলিম (রহ:)-সহ মহান মুহাদ্দীসবৃন্দ কোনো না কোনো মযহাব, বিশেষ করে ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর মযহাবের অনুসারী ছিলেন। তবে প্রতিটি মযহাবের অভ্যন্তরে নেতৃস্থানীয় উলেমাবৃন্দ নিজেদের স্ব স্ব মযহাবের শেকড় ও শাখা-প্রশাখার উন্নয়ন ও সংস্কার সাধনে গবেষণা চালিয়ে যান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি শুধু এটি সম্ভবই করে তোলে নি, বরং জরুরিও করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর মযহাব, যেটি কুফা ও বসরার প্রাথমিক যুগের শরয়ী আইন-কানুন বের করার পদ্ধতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটির জ্ঞান বিশারদবৃন্দ ইরাকের উপদলীয় গভীর প্রভাবের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট জালিয়াতির কারণে সে দেশে প্রসার লাভকৃত কিছু কিছু হাদীসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে ইমাম বোখারী (রহ;), ইমাম মুসলিম (রহ:) ও অন্যান্যদের হাদীস সংকলনসমূহ সহজলভ্য হওয়ার পর হানাফী উলেমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো নিজেদের মযহাব সম্প্রসারণ ও সংস্কারে এই হাদীস-সমগ্রকে ব্যবহার করেন। এই ধরনের প্রক্রিয়া দুই শতাব্দী ধরে চলে, যতোক্ষণ না হিজরী চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে তা পরিপক্কতার পর্যায়ে পৌঁছে। উপরন্তু, মযহাবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা এবং সদ্ভাব ওই সময়েই সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়। এই নীতিপ্রণেতা ইমাম গাযযালী (রহ:), যিনি নিজেই শাফেয়ী ফেকাহর চারটি গ্রন্থের রচয়িতা; এ ছাড়াও তিনি ‘আল-মুসতাসফা’ নামের একখানা পুস্তক প্রণয়ন করেন, যেটি ‘উসূলে উসূল আল-ফেকাহ ফীল্ মাযহাব’-এর ওপর সবচেয়ে অগ্রসর ও গবেষণামূলক কাজ হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃতি পেয়েছে।
শরয়ী মূল দলিল-আদিল্লার অপব্যাখ্যাগত বিপদ এড়াতে মুসলমানদের যেমন কোনো স্বীকৃত মযহাবের অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক, ঠিক তেমনি অন্যান্য মযহাবের চেয়ে নিজেদের মযহাবকে স্পষ্টতঃ শ্রেয় বিবেচনা করার ফাঁদে পড়া থেকেও তাঁদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। কিছু তাৎপর্যহীন ব্যতিক্রম বাদে মহান সুন্নী উলেমাবৃন্দ ইমাম গাযযালী (রহ:)-এর নির্দেশিত মূল্যবোধেরই অনুসরণ করেন; আর তাঁরা একে অপরের মযহাবের প্রতি নজর-কাড়া শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করেন। ইসলামী ঐতিহ্যবাহী উলেমাবৃন্দের দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তি-ই এ ব্যাপারে ওয়াকেফহাল। কতিপয় প্রাচ্যবিশারদের ধারণার ঠিক বিপরীত, ইতিবাচক (কল্যাণকর) আইনের সংস্কার বা সম্প্রসারণের সামর্থ্য এই চার মযহাবের বিবর্তন দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় নি। পক্ষান্তরে, তাতে এমন সূক্ষ্ম পদ্ধতি বিদ্যমান ছিল যা যোগ্য আলেমদেরকে কেবল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নিজেদের কর্তৃত্বে আইন-কানুন বের করার অনুমতি-ই দেয় নি, বরং বাস্তবিকপক্ষে তাঁদেরকে তা করতে নীতিগত বাধ্যবাধকতাও দিয়েছিল। (ওই সময়কার) অধিকাংশ ইসলামী জ্ঞান বিশারদের মতে, কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ জ্ঞান অর্জনকারী ও ইসলামী পাণ্ডিত্যের জন্যে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পূরণকারী বিদ্বান-ব্যক্তির পক্ষে নিজ মযহাবের ইতিপূর্বে বহাল সিদ্ধান্ত মানা বা অনুসরণ করার অনুমতি ছিল না; তাঁকে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে আইন-কানুন প্রণয়ন করতে হতো। এ ধরনের আলেমবৃন্দ ‘মুজতাহিদ’ নামে পরিচিত, যে শব্দটি হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা:)-এর প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফ থেকে এসেছে।