মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
কোনো মুসলমানের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ মতের বাইরে গিয়ে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাঁকে অবশ্যই মহা বিদ্বান হতে হবে, এ কথা খুব কম মানুষই সিরিয়াসভাবে অস্বীকার করবে। স্বল্পশিক্ষিত ও অযোগ্য লোকদের দ্বারা শরীয়তের মূল উৎসকে ভুল বোঝার এবং ফলশ্রুতিতে শরীয়তের ক্ষতি সাধনের বিপদ একদম বাস্তব, যে পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল চার মযহাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়কালে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের জীবনকে, এমন কি কতিপয় সাহাবী (রা:)-এর জীবনকে আক্রান্তকারী বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের কারণে। প্রাক ইসলামী জমানায় শাস্ত্রলিপিগত পাণ্ডিত্য-ঘাটতির দরুণ গোটা ধর্মসমূহ বিশ্বাসের দুর্বলতাজনিত ধ্বংসের মুখে পড়েছিল; আর তাই এটি অপরিহার্য হয়েছিল দ্বীন ইসলামকে (অনুরূপ) তুলনীয় কোনো পরিণতি থেকে সুরক্ষা করা। বেদআত ও বিকৃতির বিপদ থেকে একে রক্ষাকল্পে ‘উসূল’-এর মহান উলেমাবৃন্দ অতঃপর কঠিন শর্তাবলী আরোপ করেন, যা এজতেহাদের দাবিদার যে কাউকে অবশ্যঅবশ্যই পূরণ করতে হতো। এ সকল শর্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল:
(ক) আরবী ভাষায় পাণ্ডিত্য, যাতে কেবল ভাষাগত দিক থেকে শরয়ী অপব্যাখ্যার সম্ভাবনা কমানো যায়;
(খ) কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান এবং প্রতিটি আয়াত ও হাদীস প্রকাশ হবার প্রেক্ষিত/পটভূমি, আর সেই সাথে কুরআনের তাফসীর ও হাদীসের শরাহগুলোর সামগ্রিক জ্ঞান, এবং ওপরে আলোচিত সমস্ত ব্যাখ্যা-পদ্ধতি/কৌশল রপ্তকরণ;
(গ) হাদীসশাস্ত্রের বিশেষায়িত জ্ঞান, যেমন বর্ণনাকারীদের মূল্যায়ন ও ’মতন’ (মূল পাঠ/লিপি);
(ঘ) সাহাবা-এ-কেরাম (রা:), তাঁদের অনুসারী ও মহান ইমামবৃন্দের এতদসংক্রান্ত মতামত এবং ফেকাহশাস্ত্রের বইপুস্তকে গৃহীত অবস্থান ও এর পক্ষে যুক্তি, পাশাপাশি কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ’এজমা’ (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারও জ্ঞান;
(ঙ) ‘কেয়াস’ এবং এর বিভিন্ন ধরন ও শর্তাবলী সংক্রান্ত জ্ঞান;
(চ) নিজের সমাজ ও জনস্বার্থ (’মাসলাহাহ’)-বিষয়ক জ্ঞান;
(ছ) শরীয়তের সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (’মাকাসিদ’) সম্পর্কে জ্ঞান; এবং
(জ) তীক্ষ্ণ মেধা ও ব্যক্তিগত (আত্মিক) পবিত্রতা অর্জন, এবং এর পাশাপাশি করুণা, সৌজন্যবোধ ও বিনয়ের সমন্বয় সাধন।
উপরোক্ত শর্তাবলী যে আলেম পূরণ করতে পেরেছেন তাঁকে ‘মোজতাহিদ ফীল্ শার’ বিবেচনা করা যাবে; আর তিনি অস্তিত্বশীল ও প্রতিষ্ঠিত কোনো মযহাবের অনুসরণে বাধ্য নন, এমন কি অনুমতিপ্রাপ্তও নন। এ কথাই কতিপয় ইমাম সাহেব তাঁদের মহান শিষ্যদের বলেছিলেন, যখন তাঁরা শিষ্যদেরকে তাঁদের ‘তাকলিদ’ (প্রশ্নাতীত অনুসরণ) মানতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু যে বৃহত্তর সংখ্যক আলেমবৃন্দের এ রকম চোখ-ধাঁধানো শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না, তাঁদের পক্ষে ’মোজতাহিদ ফীল মাযহাব’ হওয়া সম্ভব ছিল; অর্থাৎ, তাঁরা সামগ্রিকভাবে নিজেদের মযহাবের রীতি-নীতি মেনে চলতেন, তবে নিজেদের মযহাবের অভ্যন্তরে প্রাপ্ত মতামতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন তাঁরা। এ স্তরের মোজতাহিদদের নমুনা হলেন শাফেয়ী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ইমাম নববী (রহ:), মালেকী মযহাবের কাজী ইবনে আব্দিল বারর (রহ:), হানাফী মযহাবের ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (রহ:) এবং হাম্বলী মযহাবের ইমাম ইবনে কুদামা (রহ:)। এই আলেমদের সবাই নিজ নিজ মযহাবের ব্যাখ্যামূলক মৌলনীতির অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে বিবেচনা করতেন; তথাপি তাঁরা নিজেদের সহজাত গুণ পাণ্ডিত্য ও সুবিবেচনা দ্বারা নিজ নিজ মযহাবের অভ্যন্তরে অনেক নতুন সিদ্ধান্ত প্রদানের নজির স্থাপন করেছিলেন। এই বিশেষজ্ঞদের প্রতি-ই মোজতাহিদ ইমামবৃন্দ এজতেহাদ সংক্রান্ত (উপরোক্ত) নির্দেশ দিয়েছিলেন; যেমন – ইমাম শাফেয়ী (রহ:)-এর নির্দেশ এই মর্মে ছিল যে, যদি তোমরা আমার সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কোনো হাদীস পাও, তাহলে তার অনুসরণ করবে। এটি স্পষ্ট যে আজকে কিছু লেখক যেভাবে ধারণা করে নিয়েছে তার ঠিক উল্টো, ইসলামী (উচ্চ) শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমন সর্বসাধারণের জন্যে এই সব পরামর্শ কখনোই উদ্দেশ্য করা হয় নি।