মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
মোজতাহিদদের অন্যান্য শ্রেণীর তালিকা উসূলের উলেমাবৃন্দ লিপিবদ্ধ করেছেন; তবে তাঁদের মধ্যকার পার্থক্য সূক্ষ্ম এবং তা আমাদের এই প্রতিপাদ্যের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। অবশিষ্ট শ্রেণীগুলোকে ব্যবহারিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়: প্রথমতঃ ‘মোত্তাবী’ (অনুসারী) যিনি নিজের মযহাবের অনুসরণ করেন কুরআন ও হাদীসশাস্ত্র সম্পর্কে এবং নিজ মযহাবের সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি সম্পর্কে ভালভাবে জেনে; আর দ্বিতীয়তঃ ‘মোকাল্লিদ’ (অনুকরণ/মান্যকারী) যিনি নিজের মযহাবের ইমামগণের প্রতি আস্থা রেখে মযহাবের আনুগত্য করেন, এবং এ ক্ষেত্রে মযহাবের সহস্র সহস্র সিদ্ধান্তের দলিল বা যুক্তি জানার কোনো বাধ্যবাধকতা তাঁর নেই।
কোনো মোকাল্লিদের জন্যে নিজ মযহাবের প্রামাণ্য দলিলপত্র যতোটুকু সম্ভব শিক্ষা করার পক্ষে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে প্রত্যেক মুসলমান-ব্যক্তি আলেম (ইসলামী জ্ঞান বিশারদ) হতে পারেন না। ইসলামী জ্ঞানে বিদ্বান হতে হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন, আর উম্মতে মোহাম্মদীর যথাযথ অগ্রগতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের খাতিরে অধিকাংশ মানুষের জন্যে অন্যান্য কর্মসংস্থান একান্ত আবশ্যক: যথা – হিসেব রক্ষক, সৈন্য, কসাই ইত্যাদি। এমতাবস্থায় তাঁরা মহান উলামা-এ-কেরাম হবেন এমনটি প্রত্যাশা করাও অবান্তর, এমন কি যদি আমরা ধরেও নেই যে তাঁদের সবার এই বিদ্যাচর্চার জন্যে প্রয়োজনীয় মেধা বিদ্যমান। পবিত্র কুরআন মজীদ স্বয়ং বিবৃত করে যে অপেক্ষাকৃত স্বল্প অবহিত ঈমানদারগণের পক্ষে যোগ্য বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত; এরশাদ হয়েছে, “তোমরা না জানলে ‘আহলে যিকর’-বৃন্দের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে শেখো” (১৬:৪৩)। [তাফসীর বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আহলে যিকর’ বা যিকিরের মানুষ হলেন উলেমাবৃন্দ]
অপর এক আয়াতে মুসলমানদেরকে আদেশ করা হয়েছে যেন তাঁরা (নিজেদের মধ্যে) এমন এক বিশেষজ্ঞ দল গড়ে তোলেন যাঁরা অ-বিশেষজ্ঞদেরকে হেদায়াত তথা সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দানের কর্তৃত্বভার বহন করতে সক্ষম। এরশাদ হয়েছে, “অতএব, কেন এমন হলো না যে তাদের প্রত্যেক দল থেকে একটি দল বের হতো, যাঁরা ধর্মের জ্ঞান অর্জন করতেন এবং ফিরে এসে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতেন এ আশায় যে তারা সতর্ক হবে” (৯:১২২, বাংলা ‘তাফসীরে কানযুল ঈমান’)। কুরআন ও সুন্নাহকে সঠিকভাবে বুঝতে যে সুগভীর পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন এবং শরয়ী দলিলপত্রের বিকৃতি সাধনের ব্যাপারে যে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটি নিশ্চিত যে মুসলমান সর্বসাধারণের পক্ষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তি এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর না করে বিশেষজ্ঞ মতের অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য।
এই দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কাছে সুপরিচিত ছিল: খলীফা উমর ফারুক (রা:) হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা:)-এর কিছু সুনির্দিষ্ট ফতোওয়া মেনে চলতেন এ কথা বলে, ‘তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করার ব্যাপারে আমি আল্লাহর দরবারে শরমিন্দা।’ আর হযরত ইবনে মাসউদ (রা:) পূর্ণ অর্থে মোজতাহিদ হওয়া সত্ত্বেও হযরত উমর (রা:)-এর কতিপয় সুনির্দিষ্ট ফতোওয়া মেনে চলতেন। আল-শাবী (রহ:)-এর ভাষ্যমতে, মহানবী (দ:)-এর ছয়জন সাহাবী (রা:) মানুষের উদ্দেশ্যে ফতোওয়া জারি করতেন। এঁরা হলেন সর্ব-হযরত ইবনে মাসউদ (রা:), উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা:), আলী (ক:), যায়দ ইবনে সাবেত (রা:), উবাই ইবনে কা’আব (রা:) ও আবূ মূসা আল-আশআরী (রা:)। উপরন্তু, এঁদের মধ্যে তিনজন অপর তিনজনের মোকাবেলায় নিজেদের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিতেন: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) হযরত উমর (রা:)-এর সিদ্ধান্ত পেলে নিজের সিদ্ধান্ত বাদ দিতেন; হযরত আবূ মূসা (রা:) তাঁর সিদ্ধান্ত বাতিল করতেন হযরত আলী (ক:)-এর সিদ্ধান্ত জানামাত্র-ই; আর হযরত উবাই ইবনে কা’আব (রা:)-এর সিদ্ধান্তের মোকাবেলায় হযরত যায়দ (রা:) নিজের সিদ্ধান্ত বাদ দিতেন।