বিদায় হজ্জের ভাষণে উপদেশ দিতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন, “ক্ষয়ক্ষতি বিপদে যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষতিপূরণ দান করবেন। যে ব্যক্তি আপদে বিপদে সর্বক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণকারী হবে আল্লাহতাআলা তাকে অনেকগুণ সওয়াব দেবেন।
নবুয়ত প্রাপ্তির পর যখন থেকে তিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করতে থাকতেন তখন থেকেই শুরু হয় নির্যাতন এবং তখন থেকেই তিনি সে নির্যাতন সহ্য করে ধৈর্য ধারণ করতে শুরু করেন। নবুয়তের ৭ম, ৮ম এবং ৯ম বৎসর এ অত্যাচার চরমে পেঁৗছে। তিনি এবং তার পরিবার বনী হাশেম ও বনী মোত্তালিবের সঙ্গে সংকটপূর্ণ জীবন যাপনে বাধ্য হলেন। হঠাৎ এমন অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন তা কারও জানা ছিল না। কাজেই খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী তারা প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করার সময় পাননি। শেষে তারা গাছের পাতা খেয়ে এবং শুষ্ক চামড়া সিদ্ধ পানি পান করে এই নিদারুণ কষ্টের মোকাবেলা করতে লাগলেন। তবু তাদের অভিশাপ দিলেন না। অবশেষে আলস্নাহ্ তাদের এ অবস্থা থেকে মুক্ত করলেন।
বোখারী শরীফের ১৭১৭ নং হাদিসে আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, “(আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে ভাই-বন্ধুত্ব হওয়ার পর) আনসারগণ হযরত (স.) এর খেদমতে আরজ করলেন, আমাদের এবং মোহাজের ভাইদের মধ্যে আমাদের সম্পত্তি বন্টন করে দিন। হযরত (স.) তা অস্বীকার করলেন। অতঃপর তারা বললেন, তবে মোহাজের ভাইগণ আমাদের জমিতে কাজ করবেন। সে সূত্রে তারা এর উৎপন্নে আমাদের শরীক হবেন। এতে সকলেই সম্মতি দান করলেন।”
আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘এক ইহুদী পন্ডিত নবীজী (স.)র কাছে কিছু টাকা পেত। সে. ঐ টাকার তাগাদায় আসল। ঐ সময় নবীজী (স.)র হাতে টাকা ছিল না। তাই তখন পরিশোধে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। ইহুদী পণ্ডিত বলল, টাকা উসুল না করে আমি যাব না এবং আপনাকে ছাড়ব না। নবীজী বললেন, আচ্ছা-টাকার ব্যবস্থা করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার কাছ থেকে দূরে কোথাও যাব না। সে হতে নবীজী (স.) দুপুর হতে এশার নামাজ পর্যন্ত ঐ ইহুদী পন্ডিতের কাছাকাছি থাকলেন। এমনকি রাতেও সে ওখানে থাকল এবং নবীজীও (স.) বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেলেন না। এ অবস্থায় ফজরের নামাজ পড়া হলে ছাহাবীগণ ঐ ইহুদীকে মন্দ বললেন এবং ভয় দেখালেন। নবীজী তাদের ঐ আচরণ করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, আল্লাহ তা’আলা আমাকে নিষেধ করেছেন কারও প্রতি, এমনকি কোন অমুসলিম নাগরিকের প্রতিও অন্যায় করতে। বেলা একটু বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধনাঢ্য ইহুদী কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল এবং তার সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিল। ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার দ্বারাই এমনিভাবে তিনি মানুষকে সঠিকপথে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আনাছ (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন অশিক্ষিত গ্রামের একজন লোক নবীজীর মসিজিদে এসে হঠাৎ মসজিদের ভিতরেই এক জায়গায় প্রস্রাব করতে লাগল। ছাহাবীগণ তার প্রতি তিরস্কার আরম্ভ করলে নবীজী তাদের বাধা দিয়ে বললেন, তার প্রস্রাব বন্ধ কোর না। (হঠাৎ প্রস্রাব বন্ধ করায় রোগের আশঙ্কা থাকে)। অত:পর ঐ লোকটিকে ডেকে নবীজী (সা.) তাঁর কাছে আনলেন। ঐ লোকের নিজের বর্ণনা, কসম আল্লাহর! নবী (সা.) আমাকে একটুও ধমকালেন না, কোন প্রকার কঠোরতা দেখালেন না’। তিনি মোলায়েমভাবে আমাকে বোঝালেন, মসজিদ আল্লাহর এবাদতের ঘর, মল-মূত্র ইত্যাদি অপবিত্র ও ঘৃণার বস্তুর স্থান এটা নয়। অত:পর ঐ স্থানে পানি বইয়ে দিলেন (মুসলিম শরীফ)।
আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন এক লোক নবীজীর (স.) কাছে তার প্রাপ্যের তাগাদায় আসল এবং কঠোর ভাষায় কথা বলল। ছাহাবীগণ ঐ লোকের ওপর ক্ষেপে গেল। নবীজী (স.) তাঁদের বললেন, তাকে মন্দ বোল না; পাওনাদারের বলার অধিকার থাকে (বোখারী শরীফ)।
আনাছ (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি নবীজীর (স.) সাথে পথ চলছিলাম। নবীজীর (স.) গায়ে একখানা চাদর ছিল, যার পাড় মোটা, শক্ত ও পুরু। হঠাৎ এক গ্রাম্য লোক এসে নবীজী (স.) কে ঐ চাদরে জড়িয়ে খুব জোরে টান দিল এবং বলল, জনসাধারণকে দেওয়ার যে মাল আপনার হাতে রয়েছে তা থেকে আমাকে কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তার টানে নজীবীর (স.) গ্রীবার ওপর চাদরের পাড়ের রেখা পড়ে গেল। নবীজী (স.) তার প্রতি তাকিয়ে হাসলেন এবং তাকে মাল দেওয়ার আদেশ দিলেন। (বোখারী শরীফ)। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি একদিন হযরত মুহম্মদ (স.)কে জিজ্ঞাসা করলাম ওহুদ রণাঙ্গনের থেকেও কঠিনতর অবস্থা আপনার জীবনে আর কখনও উপস্থিত হয়েছিল কি? উত্তরে হযরত (স.) তায়েফবাসীদের নির্যাতনের সর্বাধিক দুঃখ-কষ্ট পাওয়ার কথা উলেস্নখ করে তাদের অত্যাচারের লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরলেন। নবীজী (স.) যখন তায়েফের পথে হেঁটে যেতেন, ওখানকার লোকেরা তাঁর পিছনে গালাগালি দিতে দিতে চলত। শুধু তাই নয়, পাষন্ডরা তাঁর প্রতি ইট-পাথর মারতে মারতে তার দেহ মোবারক রক্তাক্ত করে ফেলতো। তাঁর পা রক্তাক্ত হয়ে যেত। এমনকি পায়ের রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে জুতা পায়ে আটকে যেত। পাথরের আঘাত সহ্য করতে না পেরে নজীবী (স.) অবসন্ন হয়ে বসে পড়লে তারা তাঁকে দুবাহু তুলে ধরত। চলতে আরম্ভ করলে পুনরায় পাথর মারতে শুরু করত। এ সময় নরাধমদের হাসি এবং হৈ হৈ ধ্বনির রোল পড়ে যেত।
ফেরেশতারা এসেছিল তায়েফবাসীকে ধ্বংস করতে। কিন্তু দয়ার সাগর ধৈর্যের পাহাড় রহমাতুলিস্নল আলামীন (স.) অনুমতি দেননি। বরাং তাঁকে চেনে না বলে তিনি তাদেরকে হেদায়েত দান করার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন, যদিও বর্তমানে তায়েফবাসী আমার প্রতি ঈমান আনল না, আমাকে আঘাত করে তাড়িয়ে দিল কিন্তু তারা বেঁচে থাকলে তাদের ওরশের সন্তান-সন্ততি হয়ত ঈমান আনবে। তাই হয়েছিল। ওহুদের জেহাদে নবীজীর দাঁত ভেঙ্গেছিল, মাথা ফেটেছিল, তার ওপর সারা দেহ মোবারকে শতের অধিক আঘাত লেগেছিল। প্রিয় পিতৃব্য হামযা (রা,) মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দা কর্তৃক তার বুক ফেঁড়ে কলিজা চিবানোর দৃশ্যসহ সত্তরজন ছাহাবীর শাহাদতের মানসিক আঘাতও কম ছিল না। নিকটবতর্ী সময়ের সেই ওহুদের দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষা প্রায় ছয় বছর আগের তায়েফের ঘটনার দুঃখকষ্টকে অধিক বলা অবশ্যই তাৎপর্যবহ।