হযরত মুহাম্মাদ মোস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি) হেজাজে অবস্থিত (বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থিত) পবিত্র নগরী মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি এমতাবস্থায় এ পৃথিবীর বুকে পা রাখেন যখন তত্কালীন বেদুঈন আরবদের অধিকাংশ ছিল মূর্তি পূজারী এবং মহানবী (স.) এর বংশধরদের মধ্য হতে মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক শুধুমাত্র ইব্রাহিম (আ.) এর আনীত শরিয়ত (হানিফ)-এর অনুসারী ছিলেন। তার জন্মের সময় হতে ২০০ বছর পূর্ব অবধি এ সময়কে জাহিলিয়্যাত বা মূর্খতার যুগ বলা হয়। আইয়ামে জাহিলিয়্যাত বা জাহিলিয়্যাতের যুগের অর্থ হচ্ছে : ‘সকল প্রকার বাতিল ও বেঠিক কর্ম সম্পাদন করা, যেগুলো মূর্খতা হতে উত্সারিত’। বেদুঈন আরবরা দৃঢ়ভাবে কোন ধর্মের অনুসারী ছিলো না এবং তারা বস্তুবাদী ছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল মূর্তি পূজারী। তারা কাঠ, পাথর, খোরমা ইত্যাদি দ্বারা তৈরী মূর্তিগুলোর উপাসনা করতো। আর অভাবের সময় তারা এ মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ক্ষুধা নিবারণ করতো। তাদের মাঝে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত হত্যার প্রথা ছিল তাদের জন্য একটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং গোত্রসমূহের মাঝে যুদ্ধ তাদের জন্য একটি স্বাভাবিক প্রথায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) মূর্তি পূজার মূলোত্পাটন করেন এবং গোঁড়ামী ও অহামিকায় পরিপূর্ণ আরবদের জীবনকে তিনি জাহিলিয়্যাত আখ্যায়িত করে এর বিরোধিতা করেন। তাদের সীমাহীন স্বাধীনতাকে তিনি পবিত্রতা ও নৈতিকতার বিস্তার প্রদানের মাধ্যমে সীমা বদ্ধ করেন। সর্ব সময় দ্বন্দে লিপ্ত এ জাতিকে তিনি এক পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি হিসেবে গড়ে তোলেন।
কুরাইশ গোত্র এবং হযরত মহানবী (স.) এর পূর্বপুরুষগণ
শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) কুরাইশ গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। গোত্রটি আরব গোত্রসমূহের মধ্যে একটি প্রভাবশালী গোত্র হিসেবে পরিচিত। ইসলামের আগমনের পরও এ গোত্রটি শত শত বছর ধরে ইসলামি হুকুমতকে শাসন করেছিল। কুরাইশ নামটির প্রসিদ্ধতা মহানবী (স.) পঞ্চম পূর্ব পুরুষ ‘কুসাই বিন কালাবে’র সাথে সম্পৃক্ত। তাঁর চতুর্থ পুরুষ ও কুসাইয়ের পুত্র হলেন ‘আব্দে মানাফ’। তিনি উত্তম ব্যবহারের কারণে জনগণের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মহানবী (স.) এর তৃতীয় পুরুষ হাশেম ছিলেন কুরাইশের অন্যতম উজ্জল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব এবং তার সন্তান আব্দুল মোত্তালিব ছিলেন নিজের যুগে আরবদের মধ্যে সবচেয়ে প্রখ্যাত এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং বুদ্ধির দিক থেকেও তার জুড়ি ছিল না। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া যমযম কূপকে পূনরায় খনন করেন। আর হাজীদেরকে আপ্যায়নের দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন। আল্লাহর রাসূল (স.) এর বংশধারা হযরত ইসামাইল (আ.) এর মাধ্যমে হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সাতে সংযুক্ত হয়। আর তার পূর্ব পুরুষরা সকলেই ছিলেন হযরত ইবরাহিম (আ.) এর আনীত শরীয়ত ‘হানিফে’র অনুসারী। আর তারা সকলেই ছিলেন একত্ববাদী।
হযরত মহানবী (স.) এর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ (আ.) ছিলেন হযরত আব্দুল মোত্তালিব (আ.) এর কনিষ্ট পুত্র। তিনি সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও আত্মসংবরণের দিক থেকে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ওয়াহাবের কন্যা হযরত আমিনার -যিনি পবিত্রতায় ছিলেন তত্কালীন যুগে দৃষ্টান্তহীন- সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হযরত আব্দুল্লাহ ব্যবসার কাজে শামে -বর্তমানে সিরিয়া- যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৫ বছর বয়সে তিনি মদিনায় ইন্তিকাল করেন। হযরত মুহাম্মাদ (স.) গর্ভে থাকা অবস্থায় হযরত আব্দুল্লাহ ইন্তিকাল করেন।
হযরত মুহাম্মাদ (স.) ১৭ই রবিউল আওয়াল হস্তি সনে (যে বছর হাবাশার বাদশাহ তার হস্তি বাহিনী নিয়ে কা’বা ঘর ধ্বংসের কুউদ্দেশ্যে মক্কা আক্রমন করে এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ক্ষুদ্রাকার পাখি আবাবিলের নিকট পরাভূত হয়। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে সূরা ফীল অবতীর্ণ হয়েছে)
মহানবী (স.) এর জন্মের দিনে যেসকল বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল
(১) সকল মূর্তি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছিল।
(২) কাসরা’র সদর দরজায় ভূমিকম্প হয় এবং এর সাথে সম্পৃক্ত ১৪টি দেয়াল ধ্বংসে যায়।
(৩) বহু বছর ধরে উপাসনা করা হত সেই ‘সাভে’ নদ (বর্তমানে ইরানে অবস্থিত) শুকিয়ে যায়।
(৪) সামাভা মরুতে পানি প্রবাহিত হয় যেখানে বহু বছর ধরে পানির কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
(৫) ফারসের অগ্নি মশাল যা হাজার বছর যাবত প্রজ্বলিত ছিল তা নিভে যায়।
(৬) বিশ্বের বিভিন্ন অত্যাচারী বাদশাহর সিংহাসন উল্টে যায়।
(৭) ঐ রাতে হেজাজ হতে একটি আলোর উদয় হয় যা মাশরেক (প্রাচ্য) পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
হযরত আমিনা (আলাইহাস সালাম) গর্ভধারণকালীন অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি কখনও এমন অনুভব করেননি যে তিনি গর্ভধারিণী এবং তিনি কখনই অন্যান্য নারীদের মত গর্ভধারণের ভারী ভাব অনুভব করেননি। বলা হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (স.) যখন জন্মলাভ করেন তখন তিনি ছিলে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র। তাঁর জন্মের সময় তার সাথে মায়ের গর্ভ হতে রক্ত বা অন্য কিছু বের হয়নি। আরো বলা হয় যে, তিনি (স.) জন্মের পর নিজের মাথা আসমানের দিকে উঁচু করেন অতঃপর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য সিজদা করেন।
হযরত আমিনা (আ.) বলেন, যখন মুহাম্মাদ (স.) এর জন্ম হয় তখন তাকে কেউ বলেছিলেন যে, মানবজাতির নেতাকে জন্ম দিয়েছো, অতএব, তার নাম রাখো ‘মুহাম্মাদ’। যখন আব্দুল মোত্তালিব এ বিষয় সম্পর্কে অবগত হলেন তখন তিনি একটি দুম্বা জবাই করে কুরাইশদের কিছু লোককে দাওয়াত করলেন আর ঐ অনুষ্ঠানে মহানবী (স.) এর নাম রাখলেন ‘মুহাম্মাদ’; যার অর্থ হচ্ছে প্রশংসিত।