হজ্জ (Hajj) ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। হজ্জের আভিধানিক অর্থ হলো সংকল্প বা ইচ্ছা করা। ইসলামী পরিভাষায় শরীয়তের যথাযথ বিধান অনুযায়ী কা‘বা শরীফের যিয়ারতের (দর্শনের) উদ্দেশ্যে গিয়ে নির্ধারিত ইবাদত পালন করাকে হজ্জ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন,
“ওয়ালিল্লাহি ‘আলান্নাসি হিজ্জুল বায়তি মানিস্তাতাআ ইলায়হি সাবীলা”
অর্থাৎ, কা‘বা গৃহের হজ্জ সেসব লোকের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যারা সেখানে যাবার যোগ্যতা রাখে।
(সূরা আলে ইমরান: ৯৮ আয়াতাংশ)
হযরত রসূলে করীম (সঃ) বলেছেন,
“সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি হজ্জ আদায় না করলো সে ইহুদী কি খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করলো সে বিষয়ে আমার কোন পরওয়া নেই”।
(তিরমিযী)
এ নির্দেশ হতে দেখা যায়, নিম্নে বর্ণিত যোগ্যতার অধিকারীর ওপরেই হজ্জ ফরয করা হয়েছে:
(১) স্বাস্থ্যবান মুসলমান,
(২) প্রাপ্ত-বয়স্ক বুদ্ধিমান,
(৩) সংসার পরিচালনার পর হজ্জে যাওয়ার মত আর্থিক সংগতি,
(৪) রাস্তার নিরাপত্তা,
(৫) স্ত্রীলোকের জন্যে মাহরিম (যাদের সঙ্গে বিবাহ অবৈধ) সঙ্গী।
সূরা বাকারার ২৫ রুকুতে আল্লাহ্ তাআলা হজ্জ যাত্রীকে উপযুক্ত পাথেয় সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। স্ত্রীলোকের মাহরিম সঙ্গী না নিয়ে হজ্জ যাত্রা নিষিদ্ধ হওয়ার বিবরণ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে দেখতে পাওয়া যায়।
তিন প্রকার হজ্জ
হজ্জ তিন প্রকার:- (১) তমত্তো-হজ্জের মাসগুলোতে (শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্জ) প্রথমে শুধু উমরাহ্র জন্যে ইহরাম বেঁধে উমরাহ্র পর অর্থাৎ বায়তুল্লাহ্র তোয়াফ ও সাফা-মারওয়ার মাঝে সাত পাক দেয়ার পর কেশ কর্তন করে ইহরাম খুলে ফেলা, এরপর আটই যিলহজ্জ নূতন করে ইহরাম বেঁধে হজ্জের অনুষ্ঠান পূর্ণ করা; (২) কিরান-মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) হতে হজ্জ এবং উমরাহ্র উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধা এবং একই ইহরামে হজ্জ ও উমরাহ সম্পন্ন করা, (৩) মুফরাদ -মিকাত হতে শুধু হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধা। এতে উমরাহ করতে হয় না।
মানাসিকে হজ্জ বা হজ্জের অনুষ্ঠান-সূচী
(ক) ইহরাম, (খ) তোয়াফ বা বায়তুল্লাহ্ পরিক্রমণ; (গ) সয়ী বা সাফা মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাত পাক দেয়া, (ঘ) উকূফে আরাফাত বা আরাফাতে অবস্থান, (ঙ) মুজদালিফা ও মীনাতে অবস্থান, (চ) রমি করা বা কংকর নিক্ষেপ, (ছ) কুরবানী করা, (জ) তোয়াফে বিদা প্রভৃতি। নিচে উক্ত অনুষ্ঠানগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো:
ক. ইহরাম:
হজ্জের বিশেষ পোশাক সেলাইবিহীন দুটি চাদর। একটি পরিধান করতে হয় এবং অপরটি গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়। এ নির্দেশ শুধু পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য। মহিলারা সাধারণ পোষাক পরিধান করতে পারেন, তবে মুখ আবৃত করা নিষেধ। ইহরাম বাঁধার পূর্বে গোসল করা উচিত। ইহরামের জন্যে দু রাকা‘আত নামায পড়ার পর নিয়্যত করার বিধান আছে। মুহরিমের জন্যে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যথা-মাথা (শুধু পুরুষের জন্য) ও মুখ আবৃত করা, সুগন্ধি ব্যবহার, কেশ মুন্ডন, নখ কাটা, শিকার করা, কোন প্রাণী হত্যা করা, ঝগড়াবিবাদ করা, গালমন্দ অথবা বাজে কথা বলা, বিবাহ করা বা বিবাহ পড়ান, সহবাস ইত্যাদি। ইহরাম অবস্থায় উচচঃস্বরে ‘তলবীয়া’ পাঠ করতে হয়। তলবীয়ার বাক্যগুলো এরূপ:-
“লাব্বায়িকা আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারীকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা শারীকালাক”
অর্থাৎ – “উপস্থিত, হে আল্লাহ্! আমি উপস্থিত; আমি উপস্থিত, তোমার কোন শরীক নেই, আমি উপস্থিত; নিশ্চয় সব প্রশংসা এবং অশেষ অনুগ্রহের তুমিই মালিক এবং আধিপত্যেরও (মালিক) তোমার কোন অংশীদার নেই।”
ইহরাম, হজ্জ ও উমরাহর জন্য তলবীয়া পাঠ করা একান্ত জরুরী। হজ্জে ৩টি ফরযের এটা অন্যতম।
খ. তোয়াফ:
দোয়া সহকারে পবিত্র কা’বা গৃহকে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে ‘তোয়াফ’ বলে। প্রথম তিন চক্করে দ্রুত পদক্ষেপ সহকারে এবং কাঁধ দুলিয়ে প্রদক্ষিণ করাকে রমল বলে। প্রথম তোয়াফকে কুদুম বলে। তোয়াফের ক্ষেত্রে হাতিম (কা’বার পরিত্যক্ত স্থান)-ও কা’বা গৃহের অন্তর্গত। কাবাগৃহের যে কোণে ‘হজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) অবস্থিত সেই কোণ হতে তোয়াফ শুরু করতে হয়। প্রতি চক্কর শেষে কালো পাথরকে চুম্বন করতে হয়। চুম্বন করা সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেও চলবে। উল্লেখ্য, হযরত উমর (রাঃ) একদিন তোয়াফ কালে চুম্বন করতে গিয়ে বলেছিলেন,
“হে পাথর! আমি জানি তোর ভালমন্দ করার কোনই ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমার প্রিয় নবীকে চুম্বন করতে দেখেছি বলে আমিও তোকে চুম্বন করলাম”।
(বুখারী ও মুসলিম)
হজরে আসওয়াদের পূর্ব কোণকে ‘রুকূনে ইয়ামনী’ বলে। সেই কোণকেও স্পর্শ বা চুম্বন করা যায়। সাত তোয়াফের পর মাকামে ইব্রাহীমে দু রাকা‘আত নামায পড়ার বিধান আছে। ১০ই যিলহজ্জ মীনাতে কুরবানী করার পর ১০, ১১ বা ১২ তারিখের মধ্যে বায়তুল্লাহ্র তোয়াফ করা হজ্জের অন্যতম ফরয। এ তোয়াফকে “তোয়াফে যিয়ারত” বলে।
গ. সয়ী:
সাফা পাহাড় হতে শুরু করে মারওয়া পাহাড় পর্যন্ত সাতবার ঘুরে আসাকে ‘সয়ী’ বলে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি স্থানে হযরত বিবি হাজেরার অনুকরণে দৌড় দিতে হয়। হজ্জ এবং উমরাহ্কারীদের এটাও একটি অনুষ্ঠান। সয়ীর পর যমযমের পানি পান করা সুন্নত।
ঘ. উকূফে আরাফাত:
৯ই যিলহজ্জ সূর্য ঢলে পড়ার পর হতে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকে ‘উকূফ’ বলে। সেদিন যুহর ও আসরের নামায জমা’ করে পড়া এবং দোয়া ও ইস্তিগফারের মাঝে সময় অতিবাহিত করতে হয়। এটা হজ্জের একটি প্রধান ফরয। রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন,
“৯ই যিলহজ্জ দিনে অথবা রাত্রে যে এক মুহূর্ত আরাফাতে অবস্থান করেছে তার হজ্জ সম্পূর্ণ হয়েছে।”
ঙ. মুজদালিফা ও মীনাতে অবস্থান:
৮ই যিলহজ্জ হতে ৯ই যিলহজ্জ আরাফাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মীনাতে অবস্থান করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সুন্নত। আবার ১০ই যিলহজ্জ হতে ১২ই অথবা ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত মীনায় থাকতে হয়। আরাফাত হতে মীনায় ফেরার পথে ‘মাশারাল হারাম’ পাহাড়ের পাদদেশে মুজদালিফা নামক স্থানে রাত্রিযাপন ও সেখানে মাগরিব ও ইশার নামায জমা’ করে পড়ার বিধান আছে।
চ. রমি করা বা কংকর নিক্ষেপ:
জমারাতুল আকাবা, উলা ও উসতাতে পাথর নিক্ষেপকে ‘রমি’ বলে। ১০ই যিলহজ্জ দ্বিপ্রহরের পূর্বে শুধু আকাবাতে এবং ১১ ও ১২ তারিখে (সম্ভব হলে ১৩ তারিখেও) সূর্য ঢলে পড়ার পর যথাক্রমে উলা, উসতা ও আকাবাতে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। সাধারণত একে রূপকভাবে শয়তানের উপর পাথর মারা বলা হয়।
ছ. কুরবানী করা:
কিরান ও তমত্তো হাজীদেরকে প্রথম দিন ‘রমি’ (প্রস্তর নিক্ষেপ) করার পর ১২ তারিখের মধ্যে মীনায় কুরবানী করতে হয়। কুরবানীর পর মস্তক মুন্ডন করার রীতি আছে। যারা কুরবানী করার সামর্থ্য রাখে না তারা দশটি রোযা রাখবে (সূরা বাকারা ২৪ রুকূ দেখুন) ।
জ. তোয়াফে বিদা:
বিদেশী হাজীদেরকে মক্কা ত্যাগের পূর্বে শেষ বারের মত কা’বা শরীফের ‘তোয়াফ’ করতে হয়। বিদায় কালের তোয়াফকে তাই বলা হয় ‘তোয়াফে বিদা’। হেরেমের সীমা মক্কা শরীফ হতে কোন দিকে তিন মাইল, কোন দিকে সাত মাইল এবং জেদ্দার দিক হতে দশ মাইল স্থানকে হেরেমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নির্ধারিত সীমার মধ্যে শিকার করা, কোন প্রাণীকে বিতাড়িত করা এবং ঘাস বা বৃক্ষ কর্তন করা নিষিদ্ধ। তবে প্রয়োজনবোধে হিংস্র ও ক্ষতিকর প্রাণী বধ করার অনুমতি আছে। মিকাত এটা হলো হেরেমের সীমানায় নির্দিষ্ট কতগুলো স্থান। ভারত, বাংলাদেশ ও পূর্বাঞ্চলের লোকদের জন্যে ইয়ালমলম পাহাড়কে ‘মিকাত’ নির্ধারণ করা হয়েছে। যারা মিকাতের সীমানার মাঝে বাস করে তারা নিজ নিজ স্থানেই ইহরাম বাঁধবে। হজ্জ ও উমরাহ্ ৮ই যিলহজ্জ হতে ১৩ই যিলহজ্জ মেয়াদের মাঝে অনুষ্ঠিত শরীয়ত নির্ধারিত কর্মকে হজ্জ বলে। বছরের অন্যান্য দিনে ইহরামের সাথে ‘তোয়াফ’ ও ‘সয়ী’ করাকে ‘উমরাহ্’ বলে। ফরয নামাযের সাথে যেরূপ সুন্নত ও নফল নামায পড়ার রীতি আছে, তদ্রুপ হজ্জের আগে ও পরে সুন্নত এবং নফল উমরাহ্ করা হয়। হজ্জে ভুলত্রুটির জন্যে ‘ফিদিয়া’, সদকা, কুরবানী ও রোযার ব্যবস্থা রয়েছে। (বিস্তারিত অবগতির জন্য সূরা বাকারার ২৪ রুকূ ও সূরা মায়েদার ১৩ রুকূ দ্রষ্টব্য)
কা‘বা শরীফ ও হজ্জের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
কোন কোন রেওয়ায়াত অনুযায়ী কা’বা শরীফের প্রথম বা মূল প্রতিষ্ঠাতা হলেন হযরত আদম (আঃ) (তফসীর ইবনে কাসীর) । পবিত্র কুরআনের মতে এটাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ।
“ইন্না আওয়ালা বাইতিও উযিয়া লিন্নাসি লাল্লাযী বিবাক্কাতা মুবারাকাঁ ওয়া হুদাল্লিল ‘আলামীন’
অর্থাৎ- নিশ্চয় সর্বপ্রথম মানব জাতির জন্য যে ঘর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল তা হলো বাক্কাতে তা আশিসপূর্ণ ও হেদায়াতের কারণ সমগ্র বিশ্বের জন্য।
(সূরা আলে ইমরান: ৯৭)
যবুর কিতাবেও এর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় (Psalm ৮৪: ৪,৬)। উল্লেখ্য, বাক্কা সেই উপত্যকার প্রাচীন নাম যেখানে বর্তমান মক্কা নগরী অবস্থিত। আজ হতে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে খোদাপ্রেমিক ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশে আপন প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত হাজেরা (রাঃ) এবং প্রাণাধিক পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে বর্তমান মক্কা শহর যেখানে অবস্থিত সেখানে রেখে যান। সে যুগে উক্ত স্থান সম্পূর্ণ জনমানবহীন ছিল। জীবন ধারনের কোন উপকরণ সেখানে ছিল না। সামান্য কিছু খাদ্য এবং পানীয়ের ব্যবস্থা করত আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে স্ত্রী-পুত্রকে রেখে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। এদিকে কয়েক দিনে যখন খাদ্য ও পানীয় নিঃশেষ হয়ে গেল তখন ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর পুত্র ইসমাঈলকে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করার জন্যে অসহায় জননী হাজেরা পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে ইতস্তত ছুটোছুটি করতে থাকেন। সব চেষ্টা যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো, তখন আল্লাহ্ তাআলা মরুভূমির তলদেশ হতে এক সুস্বাদু পানীয় জলের ফোয়ারা নির্গত করেন। প্রাচীন গ্রন্থেও এর বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায় (আদি: ২১:১৯)। এ ফোয়ারা পরবর্তীকালে ‘যমযম কূপ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তীকালে এ কূপকে কেন্দ্র করে লোক বসতি গড়ে ওঠে এবং পবিত্র মক্কা নগরীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুনরায় স্ত্রী-পুত্রের সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে মক্কায় আগমন করেন। আল্লাহ্ তাঁকে স্বপ্নযোগে একমাত্র প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। তৎকালীন যুগে সমাজে নরবলীর প্রচলন থাকায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী পুত্র ইসমাঈলকে জবাই করতে উদ্যত হন, কিন্তু আল্লাহ্তাআলা প্রত্যাদেশ বাণী দিয়ে ইসমাঈলের পরিবর্তে পশু কুরবানী করার আদেশ দিয়ে ইসমাঈলকে আল্লাহ্র বাণী প্রচারের জন্যে উৎসর্গ করার হুকুম প্রদান করেন। তখন হ’তে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)-এর পুণ্য-স্মৃতির স্মরণে প্রতি বছর পশু কুরবানীর প্রচলন হয়েছে। আদম (আঃ) কর্তৃক নির্মিত ইবাদত গৃহটি তখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই আল্লাহ্ সেই গৃহকে পুনঃ নির্মাণের জন্যে ইব্রাহীম (আঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর সহযোগে কা’বা গৃহকে নতুন করে গড়ে তোলেন। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে আল্লাহ্তাআলা হজ্জের ঘোষণা করার আদেশ প্রদান করেন। “ওয়া আয্যিন ফিন্নাসি বিল হাজ্জ” (সূরা হজ্জ, রুকু-৪)। ছাদ বিহীন কা’বা গৃহটি ৯ হাত উঁচু, ২৩ হাত দীর্ঘ এবং ২২ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট ছিল। পরবর্তীকালে কা’বা গৃহের আরো বহুবার সংস্কার করা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুওয়ত লাভের পূর্বে কোরেশরা যখন কা’বাগৃহের মেরামত করে তখন পাথরের অভাবে মূল গৃহটিকে বাধ্য হয়ে কিছুটা ছোট করতে হয়। সেই পরিত্যক্ত অংশের নাম ‘হাতিম’। তোয়াফের হিসাব রক্ষার সুবিধার্থে গৃহের এক কোণে কাল রঙের একটি পাথর স্থাপন করা হয়। এ পাথরই ‘হজরে আস্ওয়াদ’ নামে পরিচিত। বাইবেলেও এ পাথরের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, যথা-
“তা পরীক্ষাসিদ্ধ প্রস্তর, বহুমূল্যবান কোণের প্রস্তর, অতি দৃঢ়রূপে বসানো”।
(যিশাইয় – ১৮:১৬)
পবিত্র কা’বা হজ্জ এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর ঘটনা কুরআনের সূরা মায়েদা ১৩ রুকূ, বাকারা ১৫, ২৪ ও ২৫ রুকূ, হজ্জ ৪ রুকূ, সাফ্ফাত ৪ রুকূ, ইব্রাহীম ৬ রুকূ, আনকাবূত ৭ রুকূতে বর্ণিত হয়েছে। তৎসঙ্গে বাইবেলের আদি পুস্তকের ২, ১২, ১৬, ১৭, ১৮ অধ্যায় এবং যিশাইয় ৪৫:১৩, ১৪ পদ দ্রষ্টব্য।
হজ্জের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা
হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) তাঁর বিখ্যাত “তফসীরে কবীর”-এ সূরা হজ্জের যে দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন নিম্নে এর অংশ বিশেষের ভাবার্থ প্রদান করা হলো:
“আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন, আমি ইব্রাহীমকে এটাও বলে দিয়েছিলাম, এ হুকুম শুধু তোমার জন্যেই নয় বরং গোটা মানব জাতির জন্যে। লোক দূর দূর হতে আগমন করবে আর এভাবে সারা দুনিয়ায় একটি মাত্র ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকে সুগম করবে। লোকেরা কুরবানী করার পর গোসল করে নিজেদের দেহের মলিনতা দূর করার সাথে সাথে তাদের অন্তরকেও পরিষ্কার করবে এবং তারা আল্লাহ্র সাথে যে ওয়াদা করেছিল তা পূর্ণ করবে ও এ পুরাতন গৃহের তোয়াফ করবে। এতে যেন কেউ এ কথা না বুঝেন যে এ প্রাণহীন বস্তুকে খোদার তুল্য সম্মান প্রদান করা হয়েছে। তোয়াফ একটি প্রাচীন পদ্ধতি, যা কুরবানীর প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কোন লোক অসুস্থ হলে তার চারদিকে তোয়াফ করা হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল রোগাগ্রস্থ ব্যক্তির পরিবর্তে তোয়াফকারী নিজের জীবন কুরবানী করতে চায়। আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে যুগে যুগে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যারা এ গৃহের সম্মান এবং আল্লাহ্ তাআলার ইবাদতকে কায়েম রাখার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে। অন্যথায় বাহ্যিকভাবে এ তোয়াফের কোন মূল্য নেই। সূরা হজ্জের বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত হজ্জের উল্লেখ করে বলেছেন, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক বিভিন্ন দেশ ,বিভিন্ন জাতি, অসংখ্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং নানা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও মক্কায় একত্র হয়ে এ সত্যেরই সাক্ষ্য প্রদান করে থাকে যে তাদের মাঝে বর্ণ, গোত্র ও ভাষার শত শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামের তৌহীদমন্ত্র তাদেরকে একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। সমবেত মুসলিমরা তাদের কর্ম দিয়ে এটিও প্রমাণ করবে, এ কা’বা গৃহের হেফাযতের জন্য তারা সদা প্রস্তুত এবং কোন শক্তিই কা’বার বিনাশ ও মুসলমানের একতাকে নষ্ট করতে সক্ষম নয়। সমবেত জনতা দুনিয়ার কোন্ কোন্ প্রান্তে ইসলাম প্রচার লাভ করেছে শুধু তাই দেখে ক্ষান্ত হয় না, বরং এক অনাবাদ ও অনুর্বর অঞ্চল হতে একদিন যে ধ্বনি উত্থিত হয়েছিল, শত বাধা ও বিপত্তিকে অতিক্রম করে তা আজ দুনিয়ার সুদূর প্রান্ত হতে লক্ষ লক্ষ লোককে এনে একত্র করে দিয়েছে দেখে নিজেদের ঈমান তাজা করে। যেখানে রসূলে করীম (সাঃ)-এর জন্ম ও কর্মভূমি ছিল, যেখানে এককালে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বাক্য উচ্চারণ করার অনুমতি ছিল না, আজ সেখানে লক্ষ কন্ঠে ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল্ হামদ’ ও ‘লাব্বায়িকা লা শারীকা লাক’ উচ্চ আওয়াজে ধ্বনিত হচ্ছে। প্রতি বছর অগণিত লোক সমবেত হয়ে জীবন্ত ধর্ম ইসলামের এবং রসূলে করীম (সাঃ)-এর সত্যতা প্রমাণ করছে। হজ্জের প্রকৃত আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হলো সব ধরনের সম্পর্ককে ছিন্ন ও চূর্ণ করে একমাত্র আলাহ্ তাআলার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা। তাই এ উদ্দেশ্যকে বাস্তবে সার্থক করে তোলার জন্যে ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন তারা পার্থিব সব কিছুকে পরিত্যাগ করে মক্কা মুর্কারমায় উপস্থিত হয় এবং এভাবে জন্মভূমি প্রিয়পরিজন ও সহায়সম্পদকে কুরবানী করার শিক্ষা গ্রহণ করে। সব পার্থিব বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহ্র ইচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করাই হজ্জের প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাই যদি কেউ স্বপ্নে হজ্জ করতে দেখে তা হলে এর তা’বির (ব্যাখ্যা) হলো, উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়া আর মানব জন্মের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহ্র ইবাদত করা। তাই হজ্জ মানব জন্মের উদ্দেশ্যকে সফলতা দান করতে সাহায্য করে। হজ্জ সম্পন্ন করতে গিয়ে ও অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক হাজী প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের হযরত ইব্রাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও হাজেরার নজীর বিহীন ঐশীপ্রেম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার অপূর্ব দৃশ্যকে মানব নেত্রে দর্শন করে নিজেদেরকে তদরূপ গড়ে তোলার প্রেরণা লাভ করে। আল্লাহ্র রাস্তায় নিঃশেষে সবকিছু দান করলে এতে ক্ষয় হয় না, জয় ও অমরত্ব লাভ করা যায়। হজ্জ এটা জ্বলন্ত ও জীবন্ত করে তুলে ধরে। হজ্জের আর একটি প্রধান শিক্ষা হলো মুসলমানদের অন্তরে কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা সৃষ্টি করা। ইসলামের মূল কেন্দ্রে একত্র হয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত বিশ্বাসী ভাইয়েরা একে অপরের সমস্যাকে উপলব্ধি করার এবং একে অপরের সৌন্দর্যকে দর্শন করে নিজেদের জীবনকে উৎকৃষ্ট আদর্শে রূপায়িত করে বিশ্বশান্তির পথকে সুগম করার সুযোগ লাভ করে।
পরিশিষ্ট
সূরা বাকারার ২০৪ আয়াতের তফসীর করতে গিয়ে হজ্জের তত্ত্ব ও তাৎপর্য সম্বন্ধে নিম্নোক্ত সারমর্ম তফসীরে কবীরে বর্ণিত হয়েছে:
“হজ্জ একটি মহান আধ্যাত্মিক বিধান। কুরআনের শিক্ষা অনুসারে মানব জাতির জন্যে সর্বপ্রথম উপাসনালয় বা ইবাদত গৃহ হলো কা’বা (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)। হযরত আদম (আঃ) এটা নির্মাণ করেছিলেন এবং হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ কা’বা পুনঃ নির্মাণ করেছিলেন। কুরআন করীম একে ‘সুপ্রাচীন’ গৃহ বলে অভিহিত করেছে (সূরা আল্ হাজ্জ: ৩০ ও ৩৪ আয়াত )। ইহূদী শাস্ত্রের এক বর্ণনায় আছে, আব্রাহাম সেই উপাসনালয় পুনর্নিমাণ করেছিলেন যা আদম কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এরপর তা নূহের মহাপ্লাবনে বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং নূহ কর্তৃক পুনর্নিমিত হয়েছিল এবং পরে ভাঙ্গনের যুগে (Age of Divisions) বিধ্বস্ত হয়েছিল। [The Targums of onkelos and Jonathan ben Uzziel-translated by T.W Ethebrige, Page-226]
এ বর্ণনার সাথে একমাত্র কা’বারই সামঞ্জস্য রয়েছে। কারণ এত প্রাচীন কালের এরূপ আর কোন উপাসনালয় নেই। এটা আল্লাহ্র ইচ্ছা যে এ কেন্দ্রস্থলে বিভিন্ন স্থানের মানুষ একত্র হয়ে মানব জাতির একত্ব এবং বিশ্বনিয়ন্তার সাথে সব মানবের নিগূঢ় সম্পর্কের বিষয়ে অবহিত হবে। জাতিতে বিরাজমান কৃত্রিম পার্থক্যগুলোকে ভুলে মানবতা বোধের ঐক্য-বন্ধনে আকৃষ্ট হবার জন্য হজ্জের এ অনুষ্ঠান তথা মহামিলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন জাতির লোক হজ্জের উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে এবং কল্যাণমূলক বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করতে পারে। এ সুযোগকে হজ্জ যাত্রীর জন্য আরও বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে শুধু মক্কার চার দেয়ালের মাঝেই তাকে থাকতে বলা হয় নি, অধিকন্তু মীনা, মুজদালিফা, আরাফাত এবং পুনরায় মীনায় অবস্থান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেসব বস্তু বা স্থানের সাথে হজ্জ পালনকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে সেগুলোকে কুরআন করীমে ‘আল্লাহ্র নিদর্শন’ বা প্রতীকরূপে আখ্যা দেয়া হয়েছে (২:১৫৯, ৫:৩, ২২:৩৩)। বস্তুতপক্ষে এগুলোকে আল্লাহ্ তাআলা কতগুলো অন্তর্নিহিত বিষয়ের প্রতীকরূপে ব্যবহার করেছেন যার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
ক) কা’বা বা বায়তুল্লাহ্ (আল্লাহ্র ঘর) উপাসনার সুপ্রাচীন এবং র্সবপ্রথম গৃহ। এ গৃহের চারদিকে হজ্জ যাত্রীরা দোয়া পড়তে পড়তে তোয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন এবং তারা স্মরণ করেন আল্লাহ্র একত্ব ও মহত্ত্বের কথা। গোটা মানব জাতির একত্বের শিক্ষাও রয়েছে এ তোয়াফের মাঝে।
খ) সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌড়ানোর মাধ্যমে হজ্জ যাত্রীরা স্মরণ করেন হযরত ইসমাঈল (আঃ) এবং হাজেরার করুণ অবস্থার কথা। তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন কিভাবে আল্লাহ্ তাআলা জনমানবহীন অঞ্চলে নির্বাসিত নিঃসহায় বান্দাকে সাহায্য করেছিলেন।ত
গ) ‘মীনা’ শব্দটি ‘উমনীয়া’ শব্দ হতে এসেছে। এর অর্থ হলো কোন উদ্দেশ্য বা কোন অভিপ্রায়। মীনাতে যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাৎ লাভের ইচ্ছা পোষণ করা। মীনা হতে মুজদালিফায় গমন করতে হয়।
ঘ) ‘মুজদালিফা’ শব্দটির অর্থ হলো নৈকট্য। এর দ্বারা হজ্জ যাত্রী হৃদয়ঙ্গম করেন, যে উদ্দেশ্যে তিনি এসেছেন তা নিকটতর বা আসন্ন। মুজদালিফার আরেকটি নাম হলো ‘মাশআ’রাল হারাম’ এর অর্থ পবিত্র প্রতীক। এটা ইঙ্গিত করছে যে আল্লাহ্র সাথে মিলিত হবার এক পরম লগ্ন উপস্থিত হয়েছে। মুজদালিফার পর আরাফাতে যেতে হয়।
ঙ) ‘আরাফাত’ কথাটির মূল অর্থ চিনতে পারা বা জানতে পারা। আরাফাতের অবস্থান হজ্জ যাত্রীকে সেই অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
চ) বিশ্ববাসীর এ মহামিলনের জন্য যে স্থানকে আল্লাহ্ তাআলা নির্বাচিত করেছেন, তা কোন শস্যশ্যামল, সুশোভিত স্থান নয়, বরং তা কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী এক অনুর্বর শুষ্ক ভূমি (১৮:৩৮), সেখানে রয়েছে শুধু বিস্তীর্ণ বালুকারাশি, কঙ্কর এবং ভঙ্গুর শিলাময় ভূমি। এরূপ একটি স্থান এ জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছে যেন এতে আমরা বুঝতে পারি, এ স্থানে সাধারণ কোন প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের আকর্ষণ নেই। সেখানে যদি কেউ যায় তবে তার যাত্রার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে খোদা, একমাত্র খোদারই নৈকট্য লাভ। এ জন্যে আল্লাহ্ বলেছেন, জেনে রেখো, তোমাদেরকে এ স্থানে একত্র করা হয়েছে তাঁর সাথে মিলিত হবার জন্যে (কোন পার্থিব উদ্দেশ্যে নয়) (সূরা বাকারা: ২০৪)।
ছ) ‘ইহরাম’ দ্বারা কিয়ামতের দৃশ্যের কথা মনে করানো হয়। মৃত ব্যক্তির ন্যায় হজ্জ যাত্রী সেলাইবিহীন দু খানা চাদর দিয়ে নিজ দেহ আবৃত করেন। এ অবস্থা আরাফাতে অবস্থানকালে হজ্জযাত্রীদেরকে কিয়ামত দিবসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেন মৃত অবস্থা হতে শুভ্র পরিচ্ছদে আবৃত হয়ে মানবমন্ডলী তাদের রবের (প্রভু-প্রতিপালকের) সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে।
জ) মীনাতে অবস্থানকালে তিনটি স্তম্ভের (জামারাতুল উলা বা দুনিয়া, উস্তা এবং আকাবা) তিন বার প্রস্তর নিক্ষেপের মাধ্যমে হজ্জ যাত্রী মানব জীবনের তিনটি স্তর সম্বন্ধে স্মরণ করে: (১) পার্থিব বা দুনিয়ার জীবন যা ‘জামারাত আল্ দুনিয়া’ বা নিকটস্থ স্তম্ভ দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে, (২) কবরের স্তর বা মধ্যবর্তী স্তম্ভ (ইহজীবন এবং পরজীবনের মাঝে বিদ্যমান) যা জামারাত আলউস্তা’ বা মধ্যবর্তী স্তম্ভ বলে অভিহিত এবং (৩) পরকালের জীবন (আকাবা বলে পরিচিত) যা “জামারাত আল্-আকাবা” দিয়ে চিহ্নিত হয়েছে। এ সব স্তম্ভে প্রস্তর নিক্ষেপের মাধ্যমে শয়তানকে প্রস্তরাঘাত করার প্রতীক মনে করা হয়। ফলত মানুষের মন হতে সব প্ররোচনা এবং কুচিন্তা বিতাড়িত করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্র উপস্থিতি শয়তানকে বিতাড়িত করে।
ঝ) পশু কুরবানীর মাধ্যম হজ্জ যাত্রীগণ স্মরণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানীর কথা, তাঁদের নজিরবিহীন ত্যাগ এবং তিতিক্ষার কথা। রূপকভাবে এর মাঝে এ শিক্ষা নিহিত রয়েছে যে মানুষ যেন শুধু নিজেকে কুরবানী করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত না রাখে, উপরন্তু তাকে তার ধন-সম্পদ এমন কি সন্তানসন্ততিকেও আল্লাহ্র পথে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ঞ) কা’বার চতুর্দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা, সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাতবার দৌড়ানো; ইত্যাদির মাঝে ‘সাত’ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। আরবী ভাষায় ‘সাত’ পূর্ণতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (আকরাব, আল্ মাওয়ারিদ প্রভৃতি আরবী অভিধান দ্রষ্টব্য)। বিশেষ করে হজ্জের সময় এবং জীবনের অন্যান্য বিষয়েও হজ্জযাত্রীকে ‘পূর্ণতার’ দিকে দৃষ্টি দিতে হবে অর্থাৎ কোন প্রকার অসমাপ্ত বা অপূর্ণ কাজে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সংক্ষেপে বলা যায়, হজ্জের বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মাঝে যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয় বা যে সব কাজ করা হয় সেগুলো প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ প্রতীকগুলোতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে”।
(তফসীরে কবীর, প্রথম খন্ড, সূরা বাকারার ২০৪ আয়াতের তফসীর)
হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর দোয়া
সুফী আহমদ জান লুধিয়ানভীর মাধ্যমে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর পক্ষ হতে বায়তুল্লাহ্ শরীফে এ দোয়া পাঠ করানো হয়। দোয়াটির বঙ্গানুবাদ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
“হে করুণাময় আল্লাহ্! তোমার অধম, অযোগ্য ও গুনাহগার দাস গোলাম আহমদ, যে তোমারই দেশ ভারতে বাস করে। তার এ বিনীত আবেদন, হে রাহমানুর রাহীম! তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও এবং আমার ত্রুটিবিচ্যুতি এবং পাপ ক্ষমা করো, কেননা তুমি গাফুরুর রাহীম। আমায় দিয়ে এমন কাজ সম্পূর্ণ করাও যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আমার আর আমার নফসের (নফসে আম্মারা) মাঝে পূর্ব পশ্চিমের দূরত্ব সৃষ্টি করো। আমার জীবন, আমার মরণ এবং আমার যাবতীয় শক্তি তোমার রাস্তায় নিয়োজিত করো। তোমার প্রেমের মাঝে আমাকে জীবিত রাখো এবং তাতেই মৃত্যু দান করো। তোমার প্রিয় লোকদের মাঝে হতে আমাকে উত্থিত করো। হে আরহামুর রাহেমীন! যে কাজের প্রচারের জন্য তুমি আমাকে আদিষ্ট করেছ এবং যে খেদমতের জন্য তুমি আমার অন্তরে প্রেরণা সৃষ্টি করেছ, একে তোমারই অনুগ্রহে পূর্ণতা দান করো। এ অধমের হাতে বিরুদ্ধবাদী এবং ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ লোকদের হুজ্জত পূর্ণ করো। এ অধম এবং তার প্রিয় ও একান্ত বাধ্য অনুসারীদের ক্ষমা করো এবং তাদেরকে অনুগ্রহের ছায়া ও সাহায্য দান করো। নিজ রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণের উপর অশেষ দুরূদ, সালাম ও বরকত নাযিল করো। আমীন, সুম্মা আমীন”।
(আল্ ফযল, ১১ অক্টোবর, ১৯৪২ সন)
সুত্র: ইসলামী ইবাদত – ৫ম সংস্করণ – ২০০৯ – পৃ: ১১৬-১১৫