জিলহজ মাসের নবম দিনটিকে আরাফার দিন বলা হয়। এ দিনে হাজীরা মিনা থেকে আরাফার ময়দানে সমবেত হন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এটিই হজের প্রধান রুকন। হাদিসে এরশাদ হয়েছে, ‘আরাফাতে অবস্থান করাই হজ। অর্থাৎ হজের সবচেয়ে বড় রুকন। ফজিলত হিসেবে এ দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। আনাস (রা.) বলেন, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রতিটি দিন ১ হাজার দিনের সমতুল্য আর আরাফার দিনটি ১০ হাজার দিনের সমান মর্যাদাপূর্ণ। (ফতহুল বারি : ৮/৭৫)। রাসূল (সা.) বলেন, আরাফার দিনটি সব দিবসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (উমদাতুল কারি : ৭/২৩৯)। নানা কারণে এ দিবসটি মুসলমানদের কাছে অবিস্মরণীয়। স্বয়ং আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে এ দিনের কসম খেয়েছেন। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ, আল্লাহ তায়ালা কোনো জিনিসের কসম খেলে তার মর্যাদা বোঝানোই উদ্দেশ্য হয়। এ মহান দিবসে ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গতাসংবলিত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম বোখারি বর্ণনা করেন, জনৈক ইহুদি খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) কে বলেছিল, ‘হে আমিরুল মোমেনিন, আপনাদের কিতাবে একটি বিশেষ আয়াত আছে, যা আমাদের কিতাবে থাকলে আমরা সেদিনটি ঈদ হিসেবে উদ্যাপন করতাম। হজরত ওমর (রা.) তা জানতে চাইলে সে বলল, সূরা মায়েদার তিন নম্বর আয়াত। যাতে বলা হয়েছে, আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। হজরত ওমর (রা.) বললেন, আমি ওই দিন এবং স্থান সম্পর্কে জানি। অর্থাৎ জুমার দিন আরাফার ময়দানে ওই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল।
প্রিয় নবী (সা.) সেদিন এক সারগর্ভ ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ছিল তাঁর ৬৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার সার-নির্যাস। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত-বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে সেই ভাষণটি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। সে ভাষণে ছিল বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া ওই ভাষণে লাগেনি। কেয়ামত অবধি বিপদসঙ্কুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান রয়েছে সেই ভাষণে। ইতিহাসে তা ‘বিদায় হজের ভাষণ’ নামে পরিচিত।
জিলহজের দশম তারিখে সারা বিশ্বে ঈদ পালিত হলেও প্রিয় নবী (সা.) নবম তারিখটিকেও ঈদ আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষত হজব্রত পালনকারীদের জন্য ঈদতুল্য। কেননা ওইদিন আরাফাতে অবস্থানরত হাজীদের ওপর আল্লাহ পাকের অজস্র রহমত বর্ষিত হয়। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, বদরের যুদ্ধের দিন বাদে শয়তান সবচেয়ে বেশি অপদস্থ, ধিকৃত ও ক্রোধান্বিত হয় আরাফার দিনে। কেননা এ দিন শয়তান আল্লাহ পাকের অত্যধিক রহমত এবং বান্দার অগণিত পাপরাশি মাফ হতে দেখতে পায়। (মুয়াত্তা, মিশকাত)। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আরাফার দিন আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করে ফেরেশতাদের সঙ্গে এভাবে গর্ব করেন_ দেখ, আমার বান্দারা কী অবস্থায় আমার দরবারে উপস্থিত হয়েছে। দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করার দরুন মাথার চুল এলোমেলো। শরীরে ও কাপড়ে ধুলাবালি লেগে আছে। লাব্বাইক বলে চিৎকার করছে। তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। হুজুর (সা.) বলেন, সেদিনকার মতো অন্য কোনো দিন অধিক সংখ্যক লোককে আল্লাহ পাক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি। (ইবনে খুজাইমা : ২৫৯)।
সুতরাং আরাফার দিনটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও গর্বের। এ সুমহান দিনের পবিত্রতা ও সম্মান রক্ষার্থে যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মনোনিবেশ করা অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা সম্মানিত মাসে নিজের প্রতি জুলুম-অন্যায় করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো, তা তার জন্যই উত্তম।’ (সূরা হজ : ৩০)।
আরাফার দিনের আমল
-জিকির, তাসবিহ পাঠ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা যেন নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহ নামের জিকির করে। (সূরা হজ : ২৭)। নির্ধারিত দিন বলে হজের দিনগুলোই বোঝানো হয়েছে, যা আরাফার দিন থেকে শুরু হয়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, এ দিনগুলোতে তোমরা বেশি করে তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পড়। তাহলিল হচ্ছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ জিকির করা। আর তাকবির ও তাহমিদ হচ্ছে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। আরাফার দিন ফরজ থেকে নিয়ে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফজর নামাজের পর উচ্চৈঃস্বরে এ তাকবির পাঠ করা ওয়াজিব।
-বেশি বেশি দোয়া, এস্তেগফার পড়া। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, সর্বোত্তম দোয়া হচ্ছে আরাফার দিনের দোয়া। (মুয়াত্তা মালিক : ৫০০)। এ দিনে দোয়া ও তওবা কবুলের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
– রোজা রাখা। নবী করিম (সা.) বলেন, আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এ রোজা দ্বারা পূর্ববর্তী এক বছরের এবং পরবর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিম : ২৮০৩)।