যুগে যুগে ইসলাম প্রচার ও দুনিয়ার যে কোন সংস্কার প্রচেষ্টায় মহিলাদের অবদান অনস্বীকার্য। দুনিয়ার উন্নতি অগ্রগতির ন্যায় ইসলামেরও বিকাশ-বৃদ্ধিতে অসংখ্য মহিলা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এ ব্যাপারে নববী যুগে মহিলারা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং যে ত্যাগ স্বীকার ইসলামের জন্য করেন তা অতুলনীয়। তবে যাদের কথা না বললেই নয় এমন কিছু ত্যাগী মহিলা সাহাবীদের নিয়ে আজকের আলোচনা। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা. এ ব্যাপারে প্রথমেই হযরত সা.-এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রা.এর নাম উল্লেখ করতে হয়। এই মহিয়সী নারী নবুওয়াতের পূর্বে নিজের বিপুল সম্পদরাজি সমাজের ইয়াতীম, মিসকীন ও বিধবাদের সাহায্যের জন্যে তাঁর সমাজসেবী স্বামীর হাতে তুলে দেন। তবে এ সম্পদ শুধু ইয়াতীম, মিসকীন ও বিধবাদের সাহায্যেই ব্যয়িত হয়নি, স্বামীর জন্যে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জনেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। পরবর্তীতে ইসলাম প্রচারে এ সম্মান ও শ্রদ্ধা অনেকটাই কাজে লেগেছে।
ইসলামের ঠিক সূচনা-পর্বে স্বামীকে নানাভাবে সাহস ও উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। স্বামীর প্রচারিত আদর্শের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ন করে এবং ঘরের বাঁদী ও দাসীদের কাছে তা যথাযথ প্রচার করে তিনি ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের চরম নির্যাতন ও নিপীড়নের দিনগুলোতে স্বামীর সাথে দীর্ঘদিন শুআবে আবী তালিবে অবরুদ্ধ থেকে এবং আপন ভাতীজা হাকীম বিন হাজাম এবং অন্যান্যদের মাধ্যমে কুরাইশদের শত্রুতা প্রশমনে সফল ভূমিকা রেখে তিনি ইতিহাসে অনন্য স্থান করে নিয়েছেন। গুজাইয়া রা. ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন হাবীব আল-বাগদাদী লিখেছেন- এই মহিলা ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশ রমণীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বহু সংখ্যক কুরাইশ রমণী ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতে কুরাইশরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। ঘটনাক্রমে এই মহিলা ছিলেন মরুচারী বেদুঈন পরিবারের সন্তান। এ কারণে কুরাইশরা তাঁকে শহর থেকে বহিস্কার করার সিদ্ধান্ত নিলো। তারপর তাঁর হাত-পা বেঁধে আপন পরিবারের কাছে পৌঁছানোর জন্যে একটি কাফেলার হাতে তুলে দেয়া হলো।কাফেলার লোকেরা তাঁকে একটি উটের পিঠে বসিয়ে রশি দিয়ে কঠোরভাবে বেধে দিলো। এর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মহিলা নিজেই বলেনঃ ‘ওরা পথিমধ্যে আমায় কোনো খাবার বা পানি পান করতে দেয়নি; বরং কোনো মঞ্জিলে যাত্রা বিরতি করলে ওরা আমার হাত-পা বাঁধা অবস্থায়ই কড়া রোদের মধ্যে ফেলে দিতো। এভাবে তিন দিন তিন রাত অতিবাহিত হলো। আমার অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে দাঁড়ালো। কোনো বিষয়ে আমার হুঁশ-জ্ঞান পর্যন্ত থাকলো না। এক রাতে আমি এই অবস্থায়ই পড়ে ছিলাম। হঠাৎ গায়েব থেকে একটা তরল পদার্থ এসে আমার মুখ স্পর্শ করলো। আমি কিছু পানীয় পান করতেই আমার হুঁশ ফিরে এলো। আমার দুর্বলতা কেটে গেলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকেরা আমায় পরিবর্তিত ও উন্নত রূপে দেখতে পেলো। তারা ভাবলো, রাতের বেলা আমি হয়ত কোনোক্রমে হাত-পায়ের বন্ধন খুলে কাফেলার পানি চুরি করে পান করেছি। কিন্তু আমাকে বাধা রশি যেমন খোলা ছিলোনা; তেমনি পানি-ভরা মশকগুলোর মুখও ছিলো বন্ধ। তারা যখন নিশ্চিত হলো যে, পানি কেউ চুরি করেনি, বরং খোদার অনুগ্রহ এবং গায়েবী সাহায্যেই আমার অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, তখন ওরা দারুণভাবে প্রভাবিত ও অনুতপ্ত হলো এবং সকলেই একযোগে ইসলাম গ্রহণ করলো।’
উল্লেখ্য, হযরত সা.-এর প্রতি মহিলার এত প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিলো যে, তাঁর সম্পর্কে কুরআনের একটি আয়াত পর্যন্ত নাযিল হয়। উম্মে শরীক দাওসিয়া রা. দারুল মুসান্নিফীন প্রকাশিত সিয়ারুস সাহাবীয়া গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, এই মহিলা কুরাইশ রমণীদের মধ্যে খুব গোপনে ইসলাম প্রচার করতেন। তাঁর প্রচেষ্টায়ই কুরাইশ রমণীদের মধ্যে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। অবশ্য তাঁর জীবন কাহিনি সম্পর্কে বিস্তৃত কিছু জানা সম্ভব হয়নি। ফাতিমা বিনতে খাত্তাব রা. এ মহিলা ছিলেন হযরত উমর রা. এর বোন। ইনি যেভাবে হযরত উমর রা.কে প্রভাবিত করেন, যার পরিণতিতে তিনি ইসলাম গ্রহণে উদ্ভূদ্ধ হন, সে ঘটনা সর্বজনবিদিত। জাহেলি যুগে যে স্বল্প সংখ্যক কুরাইশ মহিলা লেখাপড়া জানতেন, ইনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সা’দা বিনতে কুরাইজ ইবনে হাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে সিয়ারুস সাহাবীয়ায় বলা হয়েছে, সা’দা বিনতে কুরাইজের উপদেশেই হযরত উসমান রা. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইনি সম্ভবত হযরত উসমান রা.-এর খালা ছিলেন। এঁর সম্পর্কে বিস্তৃত আর কিছু জানা যায়নি। এছাড়া হিজরতের প্রাক্কালে সংঘটিত আকাবার তৃতীয় শপথে দুজন মহিলা অংশ গ্রহণ করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তাদের নাম-পরিচিতি পাওয়া যায়নি। হিজরতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী মহিলাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হলো। মক্কার কঠোর পরিবেশে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রেখে এঁরা শুধু সৎসাহসেরই পরিচয় দেননি, অনেক দুঃখ-কষ্টেরও ঝুঁকি গ্রহণ করেন। হিজরতের পর মদীনায়ও ইসলাম গ্রহণ ও তার প্রচারে মহিলারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মক্কার চেয়ে মদীনার মহিলারা বেশি স্বাধীনচেতা ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। সে কারণে তাঁরাও অধিকতর উৎসাহের সাথে ইসলাম প্রচারে অংশ গ্রহণ করেন। উম্মে সুলীম বিনতে মালহান রা. এই মহিলা খুবই দুঃসাহসী ছিলেন। ইনি এবং এঁর বোনের ইসলামের পক্ষে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা সর্বজনবিদিত।
উম্মে সুলীম রা. সম্পর্কে ইতিহাসে উদ্ধৃত, হয়েছে যে, হুনাইনের যুদ্ধে ইসলামি বাহিনির মক্কি সৈন্যেরা পলায়ন করলে যুদ্ধ জয়ের পর তিনি সমস্ত পলাতক মক্কি সৈন্যের শিরচ্ছেদ করার জন্যে হযরত সা.-কে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সহীহ মুসলিম থেকে সিয়ারুস সাহাবীয়ায় উদ্ধৃত তাঁর স্বামী আবু তালহা মূর্তি-পূজারী ছিলেন। তিনি একটি বৃক্ষের পূজা করতেন। উম্মে সুলীম মুসলমান হবার পর স্বামীকে নানাভাবে বুঝাতে থাকেন যে, মাটির বুক চিরে যে গাছের জন্ম হয়, তা কিভাবে খোদা হতে পারে? স্ত্রীর কথায় ধীরে ধীরে স্বামীর মন প্রভাবিত হয় এবং এক পর্যায়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে সা’দ থেকে সিয়ারুস সাহাবীয়ায় উদ্ধৃত, রাসূলে করীম সা.-এর যামানায় ইসলামের জন্যে অর্থ ব্যয়েও মহিলারা বিন্দুমাত্র পিছনে ছিলেন না। সহীহ বুখারিতে উল্লেখিত হয়েছে, একবার হযরত বিলাল রা. রাসূলে করীম সা. এর আহ্বানক্রমে মসজিদে নববীতে সমবেত লোকদের কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ করছিলেন। মসজিদের এক পার্শ্বে সমবেত মহিলারা এটা টের পেয়ে নিজেদের কানের দুল, হাতের চুড়ি এবং অন্যান্য অলঙ্কারাদি খুলে খুলে রাসূলের খেদমতে জমা করতে লাগলেন। মোটকথা, ইসলাম প্রচারে মহিলারা পূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে রাসূলে আকরাম সা. -এর সাথে সহযোগিতা করেন। তাঁরা নিজ নিজ স্বামী, ভৃত্য, দাসী, গোলাম, আতœীয়-স্বজন, সাক্ষাৎপ্রার্থী ও বন্ধু-বান্ধবদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ দেন।
ইসলামের পথে তাঁরা নানারূপ দুঃখ-কষ্টও ভোগ করেন। তাঁরা আবিসিনিয়ায় হিজরতেও অংশ নেন। তাঁদের ঈমান কিরূপ সুদৃঢ় ছিলো দু’-একটি ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবিসিনিয়ার খৃষ্টান পরিবেশে গিয়ে বিবি উম্মে হাবীবার স্বামী উবাইদুল্লাহ বিন জাহাশ এবং বিবি সওদার স্বামী সুকরান ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। কিন্তু এই দুই মহিলা ইসলামের ওপর অবিচল থাকেন। এর বিনিময়ে উভয়ে রাসূলে আকরাম সা.-এর স্ত্রী তথা উম্মুল মুমিনীন হবার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত উমর রা.-এর দুই দাসী জুনাইরা ও লাবীবা মক্কায় অবস্থানকালে ইসলামে দীক্ষিত হন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত উমর রা. তাদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালাতেন। তাদেরকে প্রহার করতে করতে নিজেই পরিশ্রান্ত হয়ে বিরতি দিতেন। তিনি বলতেন- কারো প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নয়, নিজেই পরিশ্রান্ত হয়ে বিরতি দিচ্ছি; কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণের পর আবার প্রহার শুরু করবো। কিন্তু এই নিষ্ঠুর প্রহারও তাঁরা মেনে নেন; তবু ইসলাম ত্যাগ করতে সম্মত হননি।
জানা যায়, আবু লাহাবের বৃদ্ধা দাসী সাওবিয়াও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে মুক্তিদান করা হয়েছিলো বলে সম্ভবত আবু লাহাব এই বৃদ্ধার ওপর নির্যাতন চালাতে সাহস পায়নি। হযরত উমর রা.-এর আতœীয়া শাফাআ বিনতে আব্দুল্লাহ কবে ইসলাম গ্রহণ করেন জানা যায়নি। তিনি লেখাপড়া জানতেন। হযরত সা. তাঁর স্ত্রী হাফসা রা.-কে লেখাপড়া শিখানোর জন্যে শাফাআকে নিযুক্ত করেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তিনিও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইবনে সা’দ -এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, বাহির থেকে অমুসলিম গোত্রগুলোর দূতেরা মদীনায় এলে মদীনার এক আনসারী মহিলা তাদের খুব মেহমানদারী করতেন। এই মেহমানদারীও ইসলাম প্রচারের জন্যে অত্যন্ত ফলপ্রসু প্রমাণিত হতো। লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষার্থী