মূল: ড: আবদুল-হাকিম মুরাদ (যুক্তরাজ্য)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সুন্নাহের অনুসরণে হেদায়াত পাওয়ার জন্যে স্ব-সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর না করে মযহাবের কোনো মহান ইমামের তাবেদারি করার যে নির্দেশনা রয়েছে, তা বৃটেনের মতো (আজমী তথা অনারব) দেশগুলোর মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্যে বাধ্যতামূলক; কেননা, সেখানে তাঁদের মধ্যে খুব স্বল্প শতাংশেরই এ বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দের অধিকার রয়েছে। এটি এই বোধগম্য কারণে যে, আরবী না জানা একজন ব্যক্তির পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সমস্ত হাদীস পড়ার ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয়। বিভিন্ন কারণে দশটির বেশি হাদীস সংকলনের বিশাল সম্ভার ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় নি। আরও তিন শতাধিক হাদীস-সমগ্র অবশিষ্ট রয়েছে, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর ‘মুসনাদ’, ইমাম ইবনে শায়বা (রহ:)-এর ‘মোসান্নাফ’, ইমাম ইবনে খোযায়মা (রহ:)-এর ’সহীহ’, আল-হাকিম (রহ:)-এর ‘মোস্তাদরাক’ এবং অনেক বহু-খণ্ডবিশিষ্ট সংকলন, যেগুলো পরবর্তী গবেষণার ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ; এ সকল বইপত্রে বৃহৎ সংখ্যক সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীস বিদ্যমান, যেগুলো এ যাবত ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বোখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসের বইতে নেই। আমরা যদি ধরেও নেই যে বিদ্যমান অনুবাদগুলো একদম যথাযথ, তবুও আরবী ভাষা না জেনে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি শরয়ী আইন-কানুন বের করার চেষ্টা একেবারেই অসম্ভব। শুধু অনূদিত হাদীসগুলোর আলোকে শরীয়তকে দেখার চেষ্টা করা সুন্নাহ’র বেশির ভাগ অংশকে অবহেলা ও বাদ দেয়ার-ই শামিল, যার ফলশ্রুতিতে মারাত্মক বিকৃতি দেখা দেবে।
আমি শুধু এর দুটো উদাহরণ দেবো। সুন্নী মযহাবগুলো আইনী বিষয়াবলী প্রয়োগের নিয়ম হিসেবে শর্তারোপ করেছে যে ‘হুদুদ’ (শরয়ী শাস্তি) সে সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না যেখানে ন্যূনতম দ্ব্যর্থবোধকতা বা অস্পষ্টতা বিরাজ করছে; আর কাজী তথা বিচারকদেরকে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতে হবে এ কথা প্রমাণের জন্যে যে ওই ধরনের দ্ব্যর্থবোধকতা বা অস্পষ্টতা অস্তিত্বশীল। আনাড়িভাবে একবার সিহাহ সিত্তা (৬টি বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ) পড়ে নিলে এর পক্ষে কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যাবে না। অথচ মযহাবের এই সিদ্ধান্ত এমন এক হাদীসের ওপর ভিত্তি করে নেয়া, যা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং যা লিপিবদ্ধ আছে ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহ:)-এর ‘মোসান্নাফ’ গ্রন্থে, আল-হারিসী (রহ:)-এর ‘মোসনাদ’ পুস্তকে, আরও আছে মোসাদ্দাদ ইবনে মোসারহাদ (রহ:)-এর ‘মোসনাদ’ কেতাবে। হাদীসটিতে এরশাদ হয়েছে: “দ্ব্যর্থবোধকতা (অস্পষ্টতা)-এর দ্বারা ‘হুদুদ’ (শাস্তি) লাঘব/অপসারণ করো।” ইমাম আস্ সানানী (রহ:) নিজ ‘আল-এনসাব’ পুস্তকে এই হাদীসের প্রেক্ষিত বর্ণনা করেন, ”এক ব্যক্তিকে মদ্যপ অবস্থায় হযরত উমর (রা:)-এর কাছে (বিচারের জন্যে) আনা হয়। তিনি ‘হদ্দ’ (শাস্তি) হিসেবে ৮০টি দোররা মারার হুকুম দেন। যখন এই শাস্তি প্রয়োগ করা হয়, তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘হে উমর (রা:)! আপনি আমার প্রতি অন্যায় করেছেন, কেননা আমি একজন গোলাম! [গোলামদের ক্ষেত্রে শাস্তি অর্ধেকমাত্র] এই কথা শুনে খলীফা উমর (রা:) বেদনার্ত হন এবং তিনি পাঠ করেন মহানবী (দ:)-এর উপরোক্ত হাদীস – “দ্ব্যর্থবোধকতা (বা অস্পষ্টতা) দ্বারা ’হুদুদ’ (শাস্তি) দূর করো।” মযহাবগুলোর অপর যে গুরুত্বপূর্ণ প্রথা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যায় তা হলো, মাগরেবের ফরয নামাযশেষে সুন্নাত নামায যতো শিগগির সম্ভব পড়ে নেয়া; হাদীসটি এরশাদ ফরমায়: “মাগরেব নামাযের পরে দুই রাকাত সুন্নাত নামায দ্রুত আদায় করো, কেননা তা ফরয নামাযের সাথে আসমানে (বেহেশ্তে) তুলে নেয়া হয়।” এই হাদীসটি ইমাম রাযিন (রহ:) তাঁর ‘জামে’ কেতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
ইসলামী আইনের বিকৃতি সাধনের আশংকাজনিত ঐতিহ্যবাহী পরহেযগারীর কারণে অতীত যুগের মহান উলেমাবৃন্দের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাঁরা নিঃসন্দেহে নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি, তাঁরা মযহাবগুলোর একনিষ্ঠ আনুগত্য করেছেন। এ কথা সত্য যে সমস্যাজর্জরিত চৌদ্দ শতকে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়্যার মতো হাতে গোনা কতিপয় ভিন্ন মতাবলম্বীর আবির্ভাব ঘটেছিল; কিন্তু এমন কি এই লোকেরাও বলে নি যে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ/সহায়তা ছাড়া অর্ধ-শিক্ষিত মুসলমানদের এজতেহাদ (গবেষণালব্ধ ইসলামী সিদ্ধান্ত) প্রয়োগ করা উচিত। এই লেখকদেরকে সাম্প্রতিককালে কবর থেকে পুনরুত্থিত করে বড় করে দেখানো হলেও ঐতিহ্যমণ্ডিত ইসলামী শাস্ত্রের ওপর পাণ্ডিত্যে তাদের প্রভাব একেবারেই নগণ্য, যা পরিস্ফুট হয়েছে ইসলামী বিশ্বের বড় বড় পাঠাগারে রক্ষিত তাদের রচনাবলীর ক্ষুদ্র সংখ্যা দ্বারা। তথাপি গত শতাব্দীতে সামাজিক টালমাটাল পরিস্থিতি এমন কিছু সংখ্যক লেখককে দৃশ্যপটে নিয়ে আসে যারা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী পাণ্ডিত্যকে বর্জনের পক্ষাবলম্বন করেছে। এই ধারার পক্ষীয়দের মধ্যে বেশি পরিচিতি পায় মোহাম্মদ আবদুহু ও রশীদ রেযা।