আমরা সাধারণ মুসলমানেরা গত ১৪০০ বছর ধরে ২০ রাক’আত তারাবীর নামায পড়ে আসছি। প্রায় ২৫০ বছরের ব্রিটিশদের তৈরীকৃত ওহাবী-খারেজী মতবাদের অনুসারীরা আজ হঠাৎ করে বলে বেড়াচ্ছে তারাবীর নামায নাকি ৮ রাক’আত। শুধু তাই নয় তাদের এই মিথ্যা দাবীকে সত্য বলে প্রমাণ করা জন্য এরা অনেক আলেমদের বই পর্যন্ত পরিবর্তন করেছে। আমরা একটির উদাহরণ দিচ্ছি। বড় পীর গাউসুল আযম আব্দুল ক্বাদীর জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর একটি বিখ্যাত কিতাব “গুনিয়াতুত তালিবীন” এর কথা। এই ওহাবী-খারেজী মতবাদের প্রচারকারীরা পাকিস্তান থেকে এই বইটি প্রকাশের সময় ২০ রাকা’আত এর স্থলে ১১(তারাবীহ ৮+বিতর ৩) লিখে ছাপায়। স্ক্যান কপিসহ নিচের লিঙ্কে দেখুন
http://
আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, ইন্টারনেটে তাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইটসমূহে যে ৮ রাক’আতের কথা বলা আছে, তা মূলত তাদের দ্বারা এই পরিবর্তিত বা নকল কিতাব থেকেই নিয়া। এই সম্পর্কে সাবধান থাকবেন আপনারা।
এছাড়াও এই দাবীর পিছনে তারা যেই হাদীস উল্লেখ করে তা তাহাজ্জুদের নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে। যা আমরা গত পর্বে সংক্ষেপে বলেছি। দেখুন আগের পোষ্টটি
https://www.facebook.com/
এখানে তাহাজ্জুদের নামায হওয়ার বিস্তারিত জবাব প্রদান করা হলোঃ
প্রথমত যারা বলে তারাবীহ্ নামায আট রাকায়াত পড়া সুন্নত, তারা দলীল হিসাবে নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ পেশ করে থাকে। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফে আছে,
عن حضرة ابى سلمة بن عبدالر حـمن رضى الله تعالى عنه انه سأل حضرة عائشة عليها السلام كيف كان صلوة رسول الله صلى الله عليه وسلم فى رمضان؟ فقالت ماكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزبد فى رمضان ولا فى غيره على احدى عشر ركعة يصلى اربعا.
অর্থ : হযরত আবূ সালমাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস উনার মধ্যে কত রাকায়াত নামায পড়তেন? তখন উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি বলেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস ও পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস ব্যতীত অন্য মাসে এগার রাকায়াতের অধিক নামায পড়তেন না। আর তিনি তা চার, চার রাকায়াত করে পড়তেন।” (পবিত্র বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৪)
খণ্ডনমূলক জবাবঃ
কয়েকটি কারণে উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা কখনোই তারাবীহ্ নামায আট রাকায়াত প্রমাণিত হয়না।
*** ১নং কারণ-
উপরোক্ত হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে فى رمضان (অর্থাৎ পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস উনার মধ্যে) এর সাথে সাথে ولا فى غيره (অর্থাৎ পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস ব্যতীত অন্য মাসে) একথাও উল্লেখ আছে। অর্থাৎ বলা হয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অন্য মাসে এরূপ এগার রাকায়াত নামায পড়তেন তদ্রুপ পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস উনার মধ্যেও এগার রাকায়াত নামায পড়তেন।
এখন প্রশ্ন হলো- পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস উনার মধ্যে না হয় তারাবীহ্ নামায পড়েছেন কিন্তু গায়রে রমাদ্বান শরীফ অর্থাৎ পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস ব্যতীত অন্য মাসে তারাবীহ্ নামায পড়বেন কিভাবে? তারাবীহ নামায তো শুধু পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাস উনার মধ্যে পড়তে হয়।
মূলত এ হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে তারাবীহ্ নামাযের কথা বলা হয়নি বরং তাহাজ্জুদ নামাযের কথা বলা হয়েছে। কেননা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সারা বছরই তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুহাদ্দিছ, আল্লামা শায়খ শামসুদ্দীন কিরমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
اما الـمراد بـها صلوة الوتر- والسوال والـجواب واردان عليه.
অর্থ : “উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার উক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাযকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবূ সালমাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রশ্ন ও উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার জবাব তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।” (কাওকাবুদ্ দুরারী শরহে বুখারী শরীফ)
উক্ত হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় হযরত শাহ্ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
رصیح انست کہ انپہ انحضرت صلی اللہ علیہ وسلم گزارد ھمہ تھجدوے بود کہ یازدہ رکعت باشد
অর্থ : “বিশুদ্ধ বা সহীহ্ মত এটাই যে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিতরসহ যে এগার রাকায়াত নামায পড়েছেন, সেটা তাহাজ্জুদ নামায ছিল।” (আশয়াতুল লুময়াত)
এ প্রসঙ্গে শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-
ان زوایت محمول بر نماز تھجداست کہ در رمضان وغیر رمضان یکسان بود
অর্থ : “উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার হতে বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা তাহাজ্জুদ নামাযের সাথে সম্পর্কিত, যা পবিত্র রমাদ্বান শরীফ ও গায়রে রমাদ্বান শরীফ-এ একই সমান ছিল।” (মুজমুয়ায়ে ফতওয়ায়ে আযীযী)
আর হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উহার ব্যাখ্যায় বলেন,
وقد او تر رسول الله صلى الله عليه وسلم- بر كعة وهلاث وخـمس وهكذا با لاو تار الى احدى عشر ركعة والرواية مترودة فى ثلاث عشرة وفى حديث شاذ سبع عشرة وكان هذه الر كعات اعتسى ما سـمينا جـملتها وترأ صلاة لا لليل وهو التهجد.
অর্থ : “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এক, তিন, পাঁচ, সাত, নয় এবং এগারো রাকায়াত বিতর আদায় করতেন। তেরো রাকায়াতের বর্ণনাটি (مترود) পরিত্যাজ্য, আর একখানা (شاذ) হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সতরো রাকায়াতের কথাও উল্লেখ আছে। আর এসকল নামাযের রাকায়াত যার সাথে আমি বিতর শব্দটি ব্যবহার করেছি, তা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রাত্রি বেলায় আদায় করতেন। আর এটাই হলো তাহাজ্জুদ নামায।” (ইহ্ইয়াউ উলুমুদ্দীন)
উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, হযরত আবূ সালমা রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত বুখারী শরীফ উনার উক্ত হাদীছ শরীফখানা তারাবীহ্ নামাযের পক্ষে মোটেও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়, বরং ওটা তাহাজ্জুদ নামাযের দলীল হিসাবেই গ্রহণযোগ্য।
*** ২নং কারণ-
তাছাড়া উক্ত হাদীছ শরীফখানা যে তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কিত, তার আরো একটি অকাট্য দলীল হলো এই যে, হাদীছ শাস্ত্রের ইমামগণ উক্ত হাদীছ শরীফখানা উনাদের স্ব স্ব কিতাবে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। যেমন-
* হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘মুয়াত্তায়ে মালিক’ উনার ৪৭ পৃষ্ঠায়
* হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘মুসলিম শরীফ’ উনার ১ম খণ্ড ২৫৪ পৃষ্ঠায়
* হযরত ইমাম আবূ দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘সুনানে আবূ দাউদ’ উনার ১ম খণ্ড ১৯৬ পৃষ্ঠায়
* হযরত ইমাম তিরমিযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘তিরমিযী শরীফ’ উনার ১ম খণ্ড ৫৮ পৃষ্ঠায় ও
* হযরত ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ‘নাসায়ী শরীফ’ উনার ১ম খণ্ড ১৫৪ পৃষ্ঠায়-
উক্ত হাদীছ শরীফকে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে বর্ণনা করেন।
আর যদি কোন কিতাবে উক্ত হাদীছ শরীফকে পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার ইবাদত হিসাবে তারাবীহর অধ্যায়ে বর্ণনা করেও থাকে, তথাপিও ওটা তারাবীহ নামাযের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করা শুদ্ধ বা গ্রহণযোগ্য হবেনা। কারণ উছূল রয়েছে-
لـماجاء الا حتمال بطل الاستد لال.
অর্থাৎ যখন কোন (হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে) সন্দেহ্ বা মতবিরোধ দেখা দিবে, তখন ওটা দলীল হিসাবে পরিত্যাজ্য হবে।
*** ৩নং কারণ-
তাছাড়া উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীছ শরীফকে হযরত মুহাদ্দিছীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা (مضطرب) সন্দেহযুক্ত বলেছেন। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে-
اشكلت روايات حضرة عائشة عليها السلام على كثير من اهل العلم حتى نسب بعضهم حديثهاالى الاصطراب.
অর্থ : “অধিকাংশ আলিমগণ উক্ত হাদীছ শরীফ উনার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এমন কি কেউ কেউ উক্ত হাদীছ শরীফকে (مضطرب) সন্দেহযুক্ত বলে আখ্যায়িত করেন।” (ফতহুল বারী শরহে বুখারী শরীফ)
কারণ, স্বয়ং উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে ছহীহ্ সনদে তেরো রাকায়াতের বর্ণনাও রয়েছে। কাজেই مضطرب সন্দেহযুক্ত হওয়ার কারণে উক্ত হাদীছ শরীফকে তারাবীহ নামাযের দলীল হিসাবে পেশ করা হাদীছ শরীফ উনার উছূল মুতাবিক সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য। কারণ, উছূল হলো (مضطرب) সন্দেহযুক্ত হাদীছ শরীফ উনার (اضطراب) বা সন্দেহ যতক্ষণ পর্যন্ত দূর করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত হাদীছ শরীফ দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবেনা। অতএব, উক্ত হাদীছ শরীফকে দলীল হিসাবে পেশ করতে হলে, প্রথমে উহার (اضطراب) বা সন্দেহ দূর করতে হবে।
*** ৪নং কারণ-
উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ শরীফখানা যে তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কিত, তার আরো একটি প্রমাণ হলো, উক্ত হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে (يصلى اربعا) অর্থাৎ তিনি তা চার চার রাকায়াত করে পড়তেন, একথা উল্লেখ আছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সেটা তারাবীহ্ নামায নয়। কারণ তারাবীহ্ নামায দুই-দুই রাকায়াত করে আদায় করা হয়।
মূলকথা হলো, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হলো যে, ওহাবীরা তাহাজ্জুদ ও তারাবীর নামাযকে এক মনে করে দেখে আট রাকায়াত তারাবীহ্ নামাযের স্বপক্ষে এরা মূল দলীল হিসাবে ‘পবিত্র বুখারী শরীফ’ এর যে হাদীছ শরীফখানা পেশ করে থাকে, ওটা মোটেও তারাবীহ্ নামাযের দলীল নয় বরং ওটা তাহাজ্জুদ নামাযের দলীল। কাজেই আট রাকায়াতের ব্যাপারে তাদের উক্ত দলীল মনগড়া, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, ছিহাহ্ সিত্তাহ এর মধ্যে আট রাকায়াত তারাবীহ্ নামাযের কোন বর্ণনা বা প্রমাণ নেই।
আর সবার শেষে আপনাদের অবাক করার মত এক তথ্য দেই। প্রায় ১৫০ বছর আগে এই ৮ রাক’আত তারাবীর দাবী যখন প্রথম উঠে তখন খোদ ওহাবীদের এক নেতাই প্রতিবাদ করেছিল
১২৮৪হিজরীতে দিল্লীর আকবারাবাদের জনৈক আলেম সর্বপ্রথম আট রাকাআত তারাবীর পক্ষে ফতোয়া প্রদান করে। তখনকার হক্কানী ওলামায়ে কিরামের প্রতিবাদের মুখে ফতোয়াটি বাতিল হয়ে যায়। পুনঃরায় ১২৮৫ হিজরীতে মাওলানা হুসাইন বাঠালবী নামক আলেম ৮ রাকাত তারাবীর ফতোয়া প্রদান করে। তার প্রতিবাদে আহলে হাদীস ফেরকার প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা গোলাম রসূল সাহেব রিসালাতুত তারাবীহ নামক একটি পুস্তক রচনা করে এবং ১২৯০ হিজরীতে প্রকাশ করে। ঐতিহাসিক এ আলোচনার দ্বারা প্রমাণ হল তথাকথিত আহলে হাদীসরাও প্রথমে বিশ রাকাত তারাবীর পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীতে তারা কোন স্বার্থে আট রাকাতে মত অবলম্বন করলেন তা তারাই ভাল জানেন।
[রাসায়েলে আহলে হাদিস ৬/২৮]
Islamic Concept of Life ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত