আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর (সেই সব নবীর পর) এমন উত্তরাধিকারীরা এলো, যারা নামাজকে নষ্ট করল ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা অনুসারে কাজ করল। তারা অবশ্যই ‘গায়’তে পতিত হবে। তবে যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও নেক আমল করে তাদের কথা স্বতন্ত্র।’ [সূরা মরিয়ম]।
হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, ‘নামাজকে নষ্ট করার অর্থ পুরোপুরি তরক করা বা বর্জন করা নয়, এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ের পরে পড়া বা কাজা করা।’ হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব বলেন, এর অর্থ পরবর্তী নামাজের সময় না আসা পর্যন্ত নামাজ বিলম্বিত করা। এটা করতে যে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং এই অভ্যাসের ওপর তওবা না করেই মারা যায়, আল্লাহ তাকে ‘গায়’ নামক স্থানে নিক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন। এটি দোজখের অত্যন্ত নিচ ও নোংরা একটি গহ্বরের নাম।
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সেই সব নামাজির জন্য ওয়াইল, যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে শিথিল। অর্থাৎ আলসেমি ও গড়িমসি করে।’ হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাঃ বলেন, আমি রাসূল সাঃ-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,এই শিথিলতা কী? তিনি বললেন, নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বিত করা। তাদেরকে নামাজি বলা হয়েছে, কিন্তু উদাসীনতা ও বিলম্বের কারণে তাদের ওয়াইলের হুমকি দেয়া হয়েছে। ওয়াইল অর্থ আজানের কঠোরতা। কারো কারো মতে, ওয়াইল হচ্ছে, জাহান্নামের এমন উত্তপ্ত একটি জায়গা, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত পাহাড়-পর্বত ফেলে দিলেও তা তীব্র দহনে গলে যাবে। তওবা ও অনুতাপ সহকারে ক্ষমা না চাইলে নামাজ কাজাকারী ও নামাজে আলস্যকারীর জন্য এই জায়গা বাসস্থান হিসেবে নির্ধারিত রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে না দেয়। যে ব্যক্তি তা করবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তাফসিরকাররা বলেছেন, ওই আয়াতে আল্লাহর স্মরণ দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে বোঝানো হয়েছে। কাজেই কেউ যদি নিজের অর্থ উপার্জন-সংক্রান্ত ব্যস্ততায় সময়মতো নামাজ না পড়ে, তবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার যে কাজ সম্পর্কে সর্বপ্রথম হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে, তা হচ্ছে নামাজ। হিসাব দিতে সক্ষম হলে মুক্তি, নতুবা ব্যর্থতা অবধারিত।’
জাহান্নামবাসী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতবাসী তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, কোন কারণে তোমরা দোজখে গেলে?তারা জবাব দেবে, আমরা নামাজ আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।…’
রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘অমুসলিমদের ও আমাদের মাঝে যে অঙ্গীকার তা হচ্ছে নামাজসংক্রান্ত। নামাজকে যে ত্যাগ করল, সে কাফের।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘বান্দার ও তার কাফের হওয়ার মাঝে কেবল নামাজ তরকের ব্যবধান।’
সহি বুখারিতে আছে, রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘যার আসরের নামাজ ছুটে যায়, তার সব সৎ কাজ বৃথা হয়ে যায়।’ অপর হাদিসে রাসূল সাঃ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগ করে, আল্লাহ তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত।’ সহি বুখারি ও মুসলিমে উমর রাঃ কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাঃ বলেন, ‘মানুষ যতক্ষণ এক আল্লাহকে মাবুদ হিসেবে মেনে না নেবে, নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আমি আদিষ্ট। এ কাজগুলো যারা করবে, তাদের রক্ত ও সম্পদ আমার হাত থেকে নিরাপদ। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকলে ভিন্ন কথা। তাদের হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহতায়ালার।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উমর রাঃ বলেন, ‘নামাজ ত্যাগকারী ইসলামের প্রদত্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবে না।’
রাসূল সাঃ আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথারীতি নামাজ আদায় করবে, তা কিয়ামতের দিন তার জন্য মুক্তির অছিলা,আলোকবর্তিকা ও যুক্তি-প্রমাণ হবে। আর যে যথারীতি নামাজ আদায় করবে না, তার জন্য তা আলোকবর্তিকাও হবে না, যুক্তি-প্রমাণও হবে না, মুক্তির অছিলাও হবে না। অধিকন্তু সে কিয়ামতের দিন ফেরাউন,কারুন, হামান ও উমাই বিন খালফের সঙ্গী হবে।’
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় কোনো কোনো মুসলিম মনীষী বলেন, উল্লিখিত চারজন কুখ্যাত কাফেরের সাথে বেনামাজির হাশর হওয়ার কারণ এই যে, নামাজ তরকের কারণ চার রকমের হয়ে থাকে। অর্থসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ; রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা,প্রশাসনিক ব্যস্ততা ও বাণিজ্যিক ব্যস্ততা। নামাজ ত্যাগের কারণ প্রথমটি হলে কারুনের সাথে, দ্বিতীয়টি হলে ফেরাউনের সাথে, তৃতীয়টি হলে হামানের সাথে এবং চতুর্থটি হলে মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উবাই বিন খালফের সাথে হাশর হবে।
বায়হাকি কর্তৃক উমর রাঃ বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল সাঃ-এর কাছে এসে বলল, ‘হে রাসূল! ইসলামের কোন কাজ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়?’ রাসূল সাঃ বললেন, ‘যথাসময়ে নামাজ আদায় করা। যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দিলো তার ধর্ম নেই। নামাজ ইসলামের খুঁটি।’
উমর রাঃ যখন আততায়ীর আঘাতে আহত হলেন, তখন তাঁকে জানানো হলো, ‘হে আমিরুল মুমিনীন। নামাজের সময় উপস্থিত।’ তিনি বললেন, ‘হঁ্যা, আমি নামাজ পড়ব। নামাজ যে ছেড়ে দেয় ইসলামের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’অতঃপর তিনি নামাজ পড়লেন, তখনো তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
বিশিষ্ট তাবেয়ি আবদুল্লাহ বিন শাকিক রহঃ বলেন, রাসূল সাঃ-এর সাহাবিরা নামাজ ছাড়া আর কোনো কাজকে ছেড়ে দিলে মানুষ কাফের হয়ে যায় বলে মনে করতেন না। আলী রাঃ ও ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত বেনামাজিকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এক ওয়াক্ত নামাজ তরক করলেও আল্লাহর সাথে যখন সাক্ষাৎ হবে তিনি ক্রুদ্ধ থাকবেন।
রাসূল সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি বেনামাজি হয়ে আল্লাহর কাছে যাবে, তার অন্যান্য কাজকে আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। ইমাম ইবনে আজম বলেছেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা, অন্যায়ভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করার পরই সবচেয়ে বড় গুনাহের কাজ হলো নামাজ তরক করা। রাসূল সাঃ আরো বলেছেন, কোনো বান্দা যখন প্রথম ওয়াক্তে নামাজ পড়ে,তখন সেই নামাজ একটি আলোকরশ্মি ছুড়তে ছুড়তে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অতঃপর কিয়ামত পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে যে, তুমি যেমন আমাকে রক্ষা করেছ, আল্লাহ তেমনি তোমাকে রক্ষা করুন। (তাবারানি)।
রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল করেন না। (১) যাকে জনগণ অপছন্দ করা সত্ত্বেও তাদের নেতা হয়ে জেঁকে বসে, (২) কোনো স্বাধীন ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করে, (৩) যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় অতীত হওয়ার পর নামাজ পড়ে।’ (আবু দাউদ)। রাসূল সাঃ আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা ওজরে দুই নামাজ একত্রে পড়ে,সে এক মস্তবড় কবিরা গুনাহ করে।’ (হাকেম)। আবু দাউদ বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘কোনো বালকের সাত বছর বয়স হলেই তাকে নামাজ পড়তে আদেশ দাও। আর ১০ বছর বয়স হলে তাকে সে জন্য প্রহার করো এবং বিছানা আলাদা করে দাও।’
একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ যথারীতি আদায় করবে, আল্লাহ তাকে পাঁচটি মর্যাদা দান করবেন। প্রথমত, তার দারিদ্র্য দূর করবেন; দ্বিতীয়ত, তাকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেবেন; তৃতীয়ত, তার আমলনামা ডান হাতে দেবেন; চতুর্থত, বিদুøৎ বেগে তাকে পুলসিরাত পার করাবেন, পঞ্চমত, তাকে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি নামাজের ব্যাপারে শৈথিল্য দেখাবে, আল্লাহ তাকে ১৪টি শাস্তি দেবেন। এর মধ্যে পাঁচটি দুনিয়ার জীবনে, তিনটি মৃতুøর সময়, তিনটি কবরে এবং তিনটি কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সময়। দুনিয়ার পাঁচটি হলো তার জীবন থেকে বরকত উঠে যাবে। তার মুখমণ্ডল থেকে সৎলোকসুলভ ঔজ্জ্বল্য দূর হয়ে যাবে, তার নেক আমলের প্রতিদান দেয়া হবে না, তার কোনো দোয়া কবুল করা হবে না, আর নেক্কার লোকের দোয়া থেকে সে বঞ্চিত হবে। মৃতুøর সময়ের তিনটি শাস্তি হলো সে অপমানিত হয়ে মারা যাবে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা যাবে,সে সারা দুনিয়ার সমুদ্রের পানি পান করলেও তার পিপাসা মিটবে না। কবরে থাকাকালে যে তিনটি শাস্তি সে ভোগ করবে তা হলো তার কবর সঙ্কুচিত হয়ে তাকে এত জোরে পিষ্ট করবে যে, এক পাশের পাঁজরের হাড় ভেঙে অপর পাশে চলে যাবে, তার কবর এমনভাবে আগুন দিয়ে ভরে দেয়া হবে যে, রাত-দিন তা জ্বলতে থাকবে এবং তাকে কিয়ামত পর্যন্ত একটি বিষধর সাপ দংশন করতে থাকবে। আর কবর থেকে বের হওয়ার সময় যে তিনটি শাস্তি সে ভোগ করবে তা হলো তার হিসাব কঠিন হবে, আল্লাহকে সে ক্রুদ্ধ দেখতে পাবে এবং সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।