আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির হেদায়তের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এ ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটলেও হেদায়তের দ্বার সদা উম্মোচিত ছিল, কখনও বন্ধ হয়নি। আওলাদে রাসূল, আউলিয়ায়ে কেরাম ও সত্যিকার নায়েবে রাসূল ওলামাগণ কাল-কালান্তরে হেদায়তের প্রজ্জ্বলিত এ মশালকে সদা অনির্বাণ রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং আছেন। পাশাপাশি মহান আল্লাহ্ এ দ্বীনের সংস্কারের জন্য প্রতি শতাব্দীতে একজন করে মুজাদ্দিদ বা দ্বীনের সংস্কারকও প্রেরণ করে থাকেন, রাসূল-এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন একজন মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি এ দ্বীনের সংস্কার করবেন। [আবু দাউদ]
গাউসুল আযম আবু মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কেবল দ্বীনের সংস্কারক ছিলেন না বরং ইসলাম বা দ্বীনে ইসলামের একজন পুনরুজ্জীবনকারীও ছিলেন। তাই তিনি ‘মুহিউদ্দিন’ বা দ্বীনের পুনরুজ্জীবনকারী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। কারণ তিনি এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন যখন ভিন্নধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তার জগতকে দারুণভাবে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করে ফেলছিল। শিরক, কুফর ও বিদআত নিত্য নবরূপে সঞ্চারিত হচ্ছিল মুসলিম মননে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। তাওহীদ ও রিসালতের পথ থেকে কেউ কেউ ছিটকে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। অন্যদিকে খ্রিস্টান জগত তদানীন্তন মুসলিম দুনিয়াকে ধ্বংস করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সেই সময় উম্মতে মুহাম্মদীকে সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য তাঁর মত একজন মুজাদ্দিদের, একজন পথ প্রদর্শকের, একজন মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। একজন মহান গাউস, একজন গাউসুল আজম, একজন দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী তথা মুহিউদ্দীন হয়ে তিনি আবির্ভূত হলেন। এমনি সময়ে হযরত বড়পীর সঠিক ইসলামের পথে মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন তাই তিনি ‘মুহিউদ্দীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। হযরত গাউসে পাক এ উপাধি সম্পর্কে বলেন, ৫১১ হিজরিতে জুমার দিন আমি যখন সফর থেকে বাগদাদে প্রবেশ করছিলাম তখন খুবই দুর্বল, অসুস্থ ও বিকৃত চেহারার এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে গমন করছিলাম এমন সময় সে আমাকে ‘‘আস্সালামু আলইকা, হে আবদুল কাদের’ বলে সালাম দিল, আমিও তার সালামের উত্তর দিলাম। তখন সে বলল, আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য কর। আমি যখন তাকে বসানোর জন্য তার গায়ে হাত দিলাম, দেখলাম হঠাৎ সে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ, সবল ও সমুজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেল, এতে আমি বিচলিত হয়ে গেলাম। তখন সে আমাকে বলল, ভয়ের কোন কারণ নেই, মূলত আমি আপনার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রেখে যাওয়া যাওয়া দ্বীন-ইসলাম, যা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষা করছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার মাধ্যমে আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন, তাই আজ থেকে আপনি ‘মুহিউদ্দিন’
পরক্ষণে আমি যখন বাগদাদের জামে মসজিদের নিকটবর্তী হলাম তখন এক ব্যক্তি আমাকে ‘হে হযরত মুহিউদ্দিন’ বলে সম্বোধন করল। জুমার নামাজ শেষে ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ ‘হে হযরত মুহিউদ্দীন’ বলতে বলতে দলে দলে লোক এসে আমার হাত চুম্বন করতে লাগলো। অথচ এর পূর্বে কেউ কখনও আমাকে এ উপাধিতে সম্বোধন করেনি।
[বাহজাতুল আসরার, কালায়েদুল জাওয়াহের ও মাজহারী জামালে মুস্তফায়ী]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘প্রত্যেকে তাই করবে যে জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’ [বুখারী] ‘‘যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য সে কাজকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। [বুখারী]
বিভিন্ন মানুষকে নানা ধরনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর হযরত গাউসে পাককে সৃষ্টি করা হয়েছে এ দ্বীনের মহান খেদমত আনজাম দেয়ার জন্যে, যা তাঁর শৈশবকাল থেকেই, বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। তিনি নিজেই বলছেন, আমি ছোট বেলায় হাল-চাষ করার জন্য যখন গরুর পিঠে হাত রাখলাম তখন গরুটি পিছন ফিরে আমাকে বলল, ‘‘হে আবদুল কাদের তোমাকে তো চাষাবাদ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, ‘‘যখন আমি বাচ্চাদের সাথে খেলতে চাইতাম তখন অদৃশ্য থেকে কেউ আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘হে বরকতময়, আমার দিকে এসো’’।
[ক্বালায়েদুল জাওয়াহের]
এভাবে মাতৃগর্ভে ১৮ পারা কোরআন হিফজ, জন্মের পরক্ষণ থেকেই রোজা পালন করা ইত্যাদি প্রমাণ করে আল্লাহ্ পাক তাঁকে সৃষ্টির পেছনে এক মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। যা তাঁর পরবর্তী জীবনে হুবহু প্রতিফলিত হয়।
জন্ম
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্মগ্রহণ করেন ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৪৭০ হিজরীর রমযান মাসের ১ তারিখ সেহরির ওয়াক্তে পারস্যের কাম্পিায়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে জিলান বা গীলান অঞ্চলের নায়ক মহল্লায় হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধারায় এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে। তাঁর আম্মা সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহমাতুল্লাহি আলায়হিও ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধারার এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের কন্যা।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির আব্বা সৈয়দ আবু সালিহ মূসা জঙ্গীদুস্ত ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত সূফী এবং আম্মাজানও ছিলেন মশহুর হাফিজা ও আবিদা।
শিক্ষা
শৈশবেই আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পিতৃহারা হন। অতি শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ হিফজ করেন। বিভিন্ন বর্ণনা মতে তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালেই ১৮ পারা কুরআন শরীফ হিফজ থাকার কারণে কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। এটা প্রকাশ পায় তখন যখন ৪ বছর বয়সে তাঁকে আম্মাজান একজন ক্বারীর কাছে কুরআন মজীদ শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। কিন্তু শিক্ষক ও আশপাশের লোকজন যখন দেখলেন যে, অতটুকু শিশু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলার সাথে সাথে একনাগাড়ে সূরা ফাতিহা থেকে ১৮ পারা পর্যন্ত মুখস্থ তিলাওয়াত করছে তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহু মানুষ তাঁকে দেখবার জন্য ভিড় করলেন এবং সবাই বলাবলি করতে লাগলেন, এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, নিশ্চয়ই এ শিশু একজন মশহুর আল্লাহর ওলী হবেন।
তিনি মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করে জিলান নগরীর এক মাদরাসায় অধ্যয়ন করেন। তাঁর আম্মা ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাগদাদ তখন মুসলিম খিলাফতের রাজধানী। বাগদাদের ‘নিযামিয়া মাদরাসা’ ছিল তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাগদাদ এসে তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ আলিম ফকীহ্ ও মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে জাহিরের তাবত বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করলেন। তিনি ইলমে তাসাওউফে সর্বোচ্চ কামালাত হাসিল করলেন। তিনি প্রথমে ইলমে তাসাওফের তা’লীম গ্রহণ করেন বিখ্যাত সূফী হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ হাম্মাদ আদ্দাব্বাস রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে। হযরত আবুল খায়ের মুহাম্মদ আদ্দাব্বাস তাঁর রুহানী শক্তির ঔজ্জ্বল্য অবলোকন করে মন্তব্য করেন যে, তিনি এক সময় সর্বশ্রেষ্ঠ সূফী হবেন।
হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পরবর্তীকালে তাসাওউফের সামগ্রিক জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করার স্বীকৃতিস্বরূপ সূফী হযরত শায়খ আবূ সাঈদ মুখররিমী রহমাতুল্লাহি আলায়হির কাছ থেকে সনদপত্র বা খিলাফতনামা প্রাপ্ত হন। ইতোমধ্যেই শ্রেষ্ঠ আলিম হিসেবে, শ্রেষ্ঠ সূফী হিসেবে, শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে তাঁর নাম বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম দুনিয়ায়। বহু লোক তাঁর দরবারে এসে ভিড় জমাতে থাকে। লোকজনের ভিড় দিনকে দিন বাড়তেই লাগল।
একদিন স্বপ্নে সরকারে দো’আলম নূরে মুজাস্সম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ওয়ায করে মানুষকে সৎপথের দিশা দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর থেকে তিনি সপ্তাহে তিনদিন ওয়ায-মাহফিলের আয়োজন করতেন।
তাঁর ওয়ায শোনার জন্য সর্বস্তরের মানুষ দলে দলে এসে সমবেত হতো। তিনি অতি দক্ষ বাগ্মী ছিলেন। লোকজন তাঁর মধুর বাণী এবং সুমিষ্ট ওয়ায ঘন্টর পর ঘন্টা মোহিত হয়ে শুনত। তাঁর ওয়াযে এমন এক মোহনীয় শক্তি ছিল যা শুনে সবাই লাভবান হতো।
গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য, কামালাতের উচ্চ মাকামে উন্নীত হবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, এমন কি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মুরাকাবা-মুশাহাদারত হন। তিনি এই সময় খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন, এমনকি গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করেন। জানা যায়, অনেক বছর তিনি বাগদাদ শরীফের বাইরে একটা টিলার উপর একটা জীর্ণ কুটিরে অবস্থান করে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।
ইন্তিকাল
৫৬১ হিজরি মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস্ সানি সোমবার রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তিকাল করেন। যে কারণে এ ১১ বলতে ১১ রবিউস্ সানিকেই বুঝানো হয় এবং এ ১১ এমন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে যায় যে, অনেক খানকা শরীফে এগারো শরীফ বা গিয়ারী শরীফও অনুষ্ঠিত হয়। তিনি শুয়ে আছেন বাগদাদ নগরীতে। বাগদাদ সূফী জগতের বিলায়তের রাজধানী। বাগদাদ গাউসুল আজমের কারণে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
গাউসুল আযম এবং কাদিরীয়া তরিকার ওপর বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় গাউসুল আযমের কয়েকখানি গ্রন্থের তরজমা বের হয়েছে। গাউসুল আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হির গ্রন্থরাজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ফতহুল গায়েব, ফতহুর রাব্বানী, সিররুল আসরার, গুনিয়াতুত্ তালেবীন, কাসিদায়ে গাউসিয়া প্রভৃতি।